১২ ডিসেম্বর ২০২৫—ঢাকার পল্টনে ঘটে যাওয়া এক নির্মম ঘটনা, ইনিকলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরীফ ওসমান হাদিকে লক্ষ্য করে সশস্ত্র হামলা, শুধু এক ব্যক্তির প্রতি সহিংসতার চিহ্ন ছিল না। এটি আমাদের রাজনৈতিক পরিবেশের ভঙ্গুরতা, আমাদের গণতন্ত্রের অশান্ত অবস্থা এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার অভাবের প্রতীক হয়ে সবার সামনে নীরবে দাঁড়িয়েছে। মাত্র একদিন আগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল; সেই একদিনের ব্যবধানেই এমন একটি অমানবিকতা ঘটতে পারে—এটা কি এক মেসেজ, নাকি এক ভয়াবহ বাস্তবতা? জাতি হিসেবে আমাদের অবস্থান কোথায়? এই দেশ কি গণতন্ত্রকে হত্যা করবে? স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে কথা বললেই কি ঘাতকের বুলেটের আঘাতে জীবন দিতে হবে?

হাদির ওপর যে গুলি চালানো হয়েছে, তা নিছক দুর্ঘটনা নয়। এটি ছিল সরাসরি পরিকল্পিত, নির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক এবং রাজনৈতিক বার্তা বহনকারী একটি কৌশল। সশস্ত্র হামলার সময় ও পদ্ধতি স্পষ্ট নির্দেশ দেয়—এটি কোনো ব্যাক্তিগত বিবাদ বা সাধারণ অপরাধমূলক ঘটনা নয়, বরং একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের সংকেত। যারা এ ধরনের সহিংসতার দিকে ধাবিত করে, তারা জানে—এই জাতি ভয় পায়, এই জনগণ ভয় পায়, এই সমাজ হতাশায় ভুগে। কিন্তু তারা ভুল করছে—কারণ ইতিহাস দেখায়, বুলেট মানুষের মনোবল ভাংতে পারে, কিন্তু মানুষের অস্তিত্ব বা প্রতিশোধের অনুভূতিকে কখনো ভগ্ন করতে পারে না।

হাদি কেনো এই সন্ধিক্ষণে? এই প্রশ্নটি শুধু এক ব্যক্তির অবস্থান সম্পর্কে নয়—এটি আমাদের সমগ্র রাজনৈতিক নিরাপত্তা, আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, এবং আমাদের জাতীয় অভ্যাসের অবস্থান সম্পর্কে। তিনি কোন অপরাধ করেছেন? তিনি কি দৃঢ় কোনো অশান্তি সৃষ্টি করেছিলেন? না, তিনি করেছেন কেবল সত্য কথা বলার অপরাধ—গণতন্ত্রের পক্ষে, জনগণের পক্ষে, স্বচ্ছতা ও ন্যায়ের পক্ষে তিনি দাঁড়িয়েছেন। সেই দৃঢ় অবস্থানই তাকে বিপজ্জনক দৃশ্যে দাঁড় করিয়েছে।

এই হামলা একটি রাজনৈতিক সংকেত—যে যারা ক্ষমতার নৈরাজ্য দেখায়, তাদের ভীত করে রাখতে যে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এই সংকেতটি শুধু হাদির জন্য নয়, এটি সকলের জন্য—যে বাংলার মানুষের জন্য কথা বলে, যে বাংলার স্বপ্ন দেখে, যে বাংলার যারা নিজেদের মত প্রকাশ করে, তাদের জন্য। তারা বলে—“মুখ খুললে বিপদ রয়েছে, আলোকপাত করলে ক্ষতি হবে, সত্য বললে গুলি হতে পারে।” কিন্তু গণতন্ত্র কি সত্য বলার জন্যই পরিচিত? গণতন্ত্র কি মানুষকে নীরব করে রাখতে চেষ্টা করে? গণতন্ত্র কি মানুষের কণ্ঠকে বুলেটে স্তব্ধ করে রাখে? না—গণতন্ত্র মানুষের স্বাধীনতা, মানুষের অধিকার ও মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার নামে প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৭১ সালে এই জাতি ২৬ মার্চ রক্তপাতের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল—তারপরও আজ ২০২৫ সালে একই প্রশ্নের মুখোমুখি আমরা দাঁড়িয়েছি। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও কি আমরা সত্যিকারের স্বাধীনতা পায়নি? যদি স্বাধীনতা থাকে, তাহলে কেন একজন তরুণ রাজনৈতিক কণ্ঠকে গুলি করে থামানোর চেষ্টা করা হচ্ছে? যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে কেন একজন প্রার্থীর নিরাপত্তা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয় রাষ্ট্র? এ প্রশ্নগুলো শুধু রাজনৈতিক নয়, এগুলো নৈতিক—এগুলো ইতিহাস, পরিচয়, এবং আমাদের আত্মার প্রশ্ন।

এই ঘটনায় প্রথম মুহূর্তেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানায়। দেশীয় সংবাদমাধ্যমগুলো—যেমন দ্য ডেইলি স্টার, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, স্থানীয় প্রতিটি সংবাদ প্ল্যাটফর্ম—ঘটনাকে আগুনে ঘি ঢালার মতো প্রথম পাতায় তুলে এনেছে। তারা রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া, প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মন্তব্যগুলো প্রকাশ করেছে। প্রায় সকল মাধ্যমেই ছিল মানুষের শোক, রাজনৈতিক নেতাদের অভিযোগ, এবং তুলোধনা—একই সাথে দাবি ছিল দ্রুত, স্বচ্ছ ও কার্যকর তদন্তের।

আন্তর্জাতিক মিডিয়া এই ঘটনাকে বাংলাদেশের নির্বাচনী পরিবেশ ও মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করছে। তারা শুধু খবর প্রকাশ করছে না; তারা বাংলাদেশের গণতন্ত্র, নির্বাচন ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে গভীর প্রশ্ন তুলছে। এই প্রশ্নগুলো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থানকে এক নতুন আলোচনায় তুলেছে—যেখানে নির্বাচন শুধু ভোটগ্রহণের নাম নয়, বরং মানুষের নিরাপত্তা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার প্রতীক হিসেবে খুঁজে দেখা হচ্ছে।

হাদির ওপর হামলা এই দীর্ঘমেয়াদী সহিংসতারই অংশ—এটি একাকী ঘটনা নয়, বরং একটি ধারাবাহিক চিত্র যেখানে রাজনীতির নীরব কণ্ঠগুলো একের পর এক নিশ্চুপ করে দেওয়া হচ্ছে।

হাদিরা মারা যায় না—এই বাক্যটি আজ শুধু একটি উক্তি নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক সত্যের অভিব্যক্তি। হাদিরা কোনো ব্যক্তিগত অস্তিত্ব নয়; তারা প্রতীক, নেতৃত্ব এবং জনগণের সত্যিকারের স্বপ্নের বাহক। ইতিহাস দেখিয়েছে, প্রতিকূলতার মধ্যে হাদিরাই জন্ম নেয়—যারা পশ্চাৎ নয়, বরং সামনের সারিতে দাঁড়ায়, যারা দেশের পতাকা উঁচিয়ে ধরে, যারা মানুষের অধিকার, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে সংগ্রাম চালিয়ে যায়। গুলি, ভয়, বা নিপীড়ন—এসবই মানুষকে থামাতে পারে না; বরং এগুলোই মানুষকে আরও দৃঢ় করে, আরও সক্রিয় করে, আরও স্বাধীনতার পক্ষে অনমনীয় করে তোলে।

যখন জনগণ দেখে তাদের প্রতিনিধির ওপর গুলি চালানো হচ্ছে, তখন তারা বিরক্ত হয়, ক্ষুব্ধ হয়, এবং প্রশ্ন তোলে—“এই দেশটি কি আমাদের?” গণতন্ত্র কি আমাদের? স্বাধীনতা কি আমাদের? সার্বভৌমত্ব কি আমাদের? যখন প্রশ্নগুলো কেন্দ্রীয় আলোচনায় আসে, তখনই প্রকৃত গণতন্ত্রের পরীক্ষা শুরু হয়। জনগণ বুঝতে পারে—যেখানে নিরাপত্তা নেই, সেখানে স্বাধীনতা একটি খালি শব্দ মাত্র। যেখানে মতপ্রকাশের ভয় রয়েছে, সেখানে মানবাধিকার একটি মৃত ধারণা।

হাদির ওপর গুলি কেবল ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়—এটি আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতার পরীক্ষা। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, যে সমাজ যদি নিরাপত্তা দেয় না, যদি নিরাপত্তা প্রদান করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেই সমাজের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা তুমুলভাবে ঝুঁকিতে থাকে। ভোটের অধিকার, প্রার্থীর নিরাপত্তা, নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা—এসবই শুধু শাসনের নিয়ম নয়, এগুলো মানুষের মৌলিক অধিকার। যদি এই মৌলিক অধিকারই রক্ষিত না থাকে, তাহলে আমাদের জনগণ নানাভাবে নির্যাতিত হবে—মানসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে।

হাদির ওপর হামলার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, শিক্ষাবিদ, মানবাধিকারকর্মী—সকলেই চাঞ্চল্য প্রকাশ করেছে। এই প্রতিক্রিয়ায় দেখা যায়, যেখানে সমাজ নিজের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে—এই হামলার পেছনের পরিকল্পনাকারী ও অনুকূলকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক বিচার করা উচিত। নাগরিক সমাজ বলছে—এটা শুধু একটি ব্যক্তি নয়, আমাদের সবার নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক অধিকার এখানে প্রশ্নবিদ্ধ।

চলমান নির্বাচনী পরিবেশের কথা আলাদা করে বিবেচনা করা প্রয়োজন। ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার ঠিক একদিন পরে—এই ঘটনার সময়সূচি খুবই চিন্তার বিষয়। এটা কি কেবল সময়ের মিল? নাকি এ ধরনের সহিংসতা পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনের ভীতি সৃষ্টির একটি অংশ? এই প্রশ্নগুলোই আমাদের ভাবায়। তবে যে কোন পরিস্থিতিতেই জনগণ ভয় পাবে না—কেননা ইতিহাস বলে, ভয় মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে পারে, কিন্তু মানুষের প্রাণশক্তি কেড়ে নিতে পারে না।

গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে—মানুষ কীভাবে এই ঘটনাগুলোকে দেখছে, কীভাবে তা থেকে শিক্ষা নিচ্ছে, কীভাবে তারা আন্দোলনের প্রতি আরও দৃঢ় হচ্ছে। গণতন্ত্র শুধু নির্বাচন বা ভোটগ্রহণ নয়—এটি মানুষের জীবনে প্রতিদিনের নিরাপত্তা, মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মানুষের নিজ নিজ সম্মানের অধিকার—এসব মিলিয়ে যেটি গড়ে ওঠে। যখনই সেই মৌলিক কাঠামো ক্ষুন্ন হয়, তখনই গণতন্ত্রের অস্তিত্ব সংকটে পড়ে।

হাদিরা শুধু একজন ব্যক্তি নয়; তারা মানুষের সাহস, মানুষের দুর্বলতা, মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা—এসবের প্রতীক। হাদিরা যখন দাঁড়ায়, তখন ইতিহাস লিখে—“এই সমাজ নীরব ছিল না, এই মানুষ ভয় পায়নি, এই দেশের মানুষ প্রতিরোধ করেছে।” তাঁরাই সেই জনশক্তি, যাদের হাতের কড়া হাতে দেশের পতাকা উঁচিয়ে রাখতে হয়—যা অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।

আমাদের উচিত—এসময় শুধু প্রতিক্রিয়া নয়, প্রতিরোধ গড়ে তোলা। বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, নিরাপত্তা ব্যবস্থার পুনর্গঠন, রাজনৈতিক দমননীতি প্রতিরোধ করা—এসব এখন সময়ের দাবি। গণতন্ত্রকে শুধু কথায় নয়, কর্মে রক্ষা করতে হবে। মানুষের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা শেষ কথা—হাদিরা শুধু মৃত্যুকে প্রতিফলিত করে না; তারা আশা এবং সংগ্রামের প্রতীক। তাদের প্রতি সহিংসতা জনগণকে থামাতে পারে না—বরং এটি আন্দোলনকে আরও দৃঢ় করে।

জুলাই বিপ্লবের পর দেশের মানুষ আরও সতর্ক হয়েছে, রাজনৈতিক সচেতনতা বেড়েছে, এবং গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার প্রতি অঙ্গীকার আরও শক্তিশালী হয়েছে। মানুষের মনোবলে আজ একটাই বক্তব্য—নিরাপত্তা থাকুক, মানুষের কণ্ঠ স্বাধীন থাকুক, গণতন্ত্র সুরক্ষিত থাকুক। হাদিরা জীবিত থাকে জনগণের হৃদয়ে, তাদের কর্মকাণ্ডে এবং দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে—এটাই আমাদের শক্তির প্রতীক।

সমাপ্তি হিসাবে বলি—হাদির ওপর গুলি কেবল ব্যক্তি নির্বিচারীর প্রতিফলন নয়; এটি আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতার কথা মনে করিয়ে দেয়। আমরা চাই বিচার, জবাব, মানুষের নিরাপত্তা এবং বাংলাদেশের মুক্তি। হাদিরা মরে না; হাদিরাই দেশের পতাকা উঁচিয়ে এগিয়ে যায়, দেশ মাতৃকার পক্ষে, সত্য ও ন্যায়ের পথে, জনগণের অধিকার রক্ষার প্রতীক হয়ে।

লেখক ও সংগঠক