রাখঢাকহীন কথা ও পাল্টাপাল্টি উত্তেজনাকর বাহাসের মধ্যে নিরাপত্তা শঙ্কা দেখিয়ে বন্ধের একদিনের মাঝেই ভারতীয় ভিসা সেন্টারের নিয়মিত কার্যক্রম ফের শুরু হয়েছে। ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে টানাপোড়েনে দু’দিনের ব্যবধানে দু’দেশের হাইকমিশনারকে তলব কাণ্ডও ঘটেছে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে ‘গভীর উদ্বেগ’ জানাতে দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে তলব করা হয়েছে। বলছে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা ঘিরে উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলি যে ভ্রান্ত বয়ান তৈরির চেষ্টা করছে, ভারত তা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে। এর ঘণ্টা দুয়েক আগে ঢাকায় ভারতীয় ভিসা কেন্দ্রের (আইভেক) কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে দেশটির হাইকমিশন। যদিও সম্পর্কের এ টানাপোড়েন শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই। মাঝেমধ্যে দুদিক থেকেই একটুআধটু নরম কথা এলেও গত ক’দিন ধরে তা আরো তুঙ্গে। দু’দিনের ব্যবধানে দু’দেশের হাইকমিশনারকে পাল্টাপাল্টি তলবের ঘটনা উত্তেজনার পারদ আরো বাড়িয়েছে। এর পূর্বাপরে কথা যেমন রয়েছে, তেমন ঘটনাও রয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সেখানে নতুন টোকা পড়েছে। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচনের বিপক্ষে বক্তব্য-বিবৃতি পরিস্থিতিকে নতুন করে গোলমাল পাকিয়ে দেয়। তারওপর তফসিল ঘোষণার পরদিনই ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেওয়া জুলাই যোদ্ধা, ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা হয়। ঘটনার পর দ্রুত ভারত পালিয়ে যায় হাদিকে হত্যাকারীরা। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন গত ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় নির্বাচনী প্রচারণার সময় মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাতে তার মৃত্যু হয়। হাদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

‘মাত্র ৩২ বছর বয়সে তার এ মৃত্যু চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর এক গভীর প্রশ্নচিহ্ন হয়ে রইল। এটি কেবল একজন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীর মৃত্যু নয়, এটি মূলত পতিত ফ্যাসিবাদ ও প্রশাসনের লুকিয়ে থাকা সহযোগীদের পক্ষ থেকে জুলাইয়ের প্রজন্মের কণ্ঠ স্তব্ধ করার সম্মিলিত প্রচেষ্টা যা দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের জন্য হুমকি স্বরূপ। ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অন্যতম পরিচিত মুখ শরীফ ওসমান হাদির প্রয়াণের সংবাদটি বিশ্ব গণমাধ্যমে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো হাদিকে কেবল একজন আহ্বায়ক হিসেবেই নয়, বরং বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করেছে। বিশ্বজুড়ে এই মৃত্যুর খবরটি যেভাবে প্রচারিত হয়েছে, তাতে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের মানবাধিকার ও নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে নতুন করে আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। হাদি হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করার বিষয়ে বিশ্ব সম্প্রদায় গভীর পর্যবেক্ষণ রাখছে বলে প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।

১৪ ডিসেম্বর ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাঁকে কড়া ভাষায় জানানো হয়, ভারতে পালিয়ে যাওয়া ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের দ্রুত অবসান চায় ঢাকা। হাদিকে হত্যার চেষ্টায় জড়িত সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা ভারতে প্রবেশ করলে তাঁদের গ্রেপ্তার করে ফেরত পাঠানোরও আহ্বানও জানানো হয়।

ওই তলবের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী কোনো কার্যকলাপে ভারতের ভূখণ্ড কখনোই ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না বলার পরই দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে তলব করে তারা(ভারত)। স্বাভাবিকভাবেই পরিস্থিতিটা উত্তেজনাকর। বিশেষ করে বাংলাদেশের শক্ত অবস্থান নেয়া ছাড়া আর গতি নেই। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন তীব্র প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ভারতের নসিহত-প্রেসক্রিপশনের কোনো দরকার নেই বাংলাদেশের। বাংলাদেশের নির্বাচন প্রশ্নে ভারতের উপদেশকে তিনি ‘সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য’ বলেছেন। ঘোরপ্যাঁচে না গিয়ে তৌহিদ হোসেন সোজা কথায় বলেছেন, ‘তারা (ভারত) জানে এর আগে গত ১৫ বছর যে সরকার ছিল, তাদের সঙ্গে অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক ছিল। ওই সময় নির্বাচনগুলো যে প্রহসনমূলক হয়েছিল, সে সময় তারা (ভারত) একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। এখন সামনে আমরা একটা ভালো নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি, এই মুহূর্তে তো আমাদের নসিহত করার কোনো প্রয়োজন নেই।’ ঢাকার অব্যাহত অনুরোধের পরও ভারতে পালিয়ে থাকা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘ভারত যদি তাঁকে(শেখ হাসিনা) থামাতে না চায়, আমরা থামাতে পারব না। এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। আমরা চাইব যে ভারত তাঁকে থামাক।’ এমন উত্তেজনাকর সময়েই বিজয় দিবসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বার্তা পাঠিয়েছেন, যেখানে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ নেই। যদিও তা গেলবছরের বার্তায়ও ছিল না। কেবল সাল বদলে গেলবারের পোস্টই এবার আবার বসিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া ভারত কোনোকালেই ১৬ ডিসেম্বরকে বাংলাদেশের বিজয় দিবস ভাবে না। তারা একে ‘ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ’ হিসেবে দেখিয়ে আসছে। ভারতের রাজনৈতিক দল বিজেপি বা কংগ্রেস-এ নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। তাদের এ নিয়ে প্রচুর সাহিত্যকর্ম রয়েছে। মাঝেমধ্যে নাটক-সিনেমাও বানায়।

এবার হাদিসহ নানা ঘটনায় এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া একটু বেশি হচ্ছে। সেখানে যোগ হয়েছে বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহর কড়া বক্তব্য। ঢাকায় এক সমাবেশে ভারতের সেভেন সিস্টার্স হিসেবে পরিচিত পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যকে ‘ভারত থেকে আলাদা’ করার বিষয়ে হুমকি দিয়েছেন তিনি। এ ধরনের হুমকি হজম করা ভারতের জন্য কষ্টের। যদিও তার দল বলছে, এটি হাসনাত আব্দুল্লাহর নিজস্ব উপলব্ধি, দলীয় অবস্থান নয়। হাসনাতের বক্তব্যে কড়া প্রতিক্রিয়ায় আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার বক্তব্যও চড়া। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের নেতারা ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে দেশটির উত্তরপূর্বাঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করার হুমকি অব্যাহত রাখলে নয়াদিল্লি চুপ থাকবে না। এ নিয়ে স্যোশাল মিডিয়ায় ঝড় তুলেছেন, ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষক, সাবেক সেনা কর্মকর্তা কর্নেল (অব.) অজয় কে রায়নার। টুইটে তিনি দাবি করেন, ওসমান হাদির পর পরবর্তী ‘টার্গেট’ হতে যাচ্ছেন হাসনাত আব্দুল্লাহ। বিতর্ক আরো গভীর হয়, যখন ওই পোস্টে তিনি কোথায় গুলি করা দরকার তাও উল্লেখ করে বলেন, ‘গুলি করতে হবে ঘাড়ে, মাথায় নয়। প্রথমে তাকে নিশ্চুপ করাতে হবে। এবং ছোট্ট ছোট্ট ভুলগুলোও শুধরে নেয়া হবে।’ এই বক্তব্য স্যোশালমিডিয়ায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে।

স্বাভাবিকভাবেই কেউ কেউ ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদির ওপর সাম্প্রতিক হামলার সঙ্গে এই বক্তব্যের সম্ভাব্য যোগসূত্র দেখছেন। এছাড়া, ভারতের আশ্রয়ে- প্রশ্রয়ে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের বাংলাদেশে সন্ত্রাস উসকে দেয়ার নানা ঘটনাও দৃশ্যমান। এসব বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানাতেই ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাকর্মীরা ভারতে বসে বাংলাদেশের আসন্ন সংসদ নির্বাচন বানচালে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর ষড়যন্ত্র করছে বলেও প্রণয় ভার্মাকে বার্তা দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তলবের সময় ভারতের হাইকমিশনারকে এসব সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর আহ্বান জানানো হয়। অথচ পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহকে তলব করলো। যদিও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘ঢাকায় কিছু চরমপন্থী গোষ্ঠী’ যেভাবে ভারতীয় দূতাবাসকে ঘিরে নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করেছে সেটাই রাষ্ট্রদূতকে তলব করার প্রধান উদ্দেশ্য-তবে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, সম্প্রতি বাংলাদেশের কোনো কোনো রাজনীতিবিদ যেভাবে প্রকাশ্য ভারত-বিরোধী মন্তব্য করেছেন সেই সব ‘উসকানিমূলক’ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানানোটাও ছিল এই সমন পাঠানোর আর একটা বড় কারণ। তলবের ঠিক পরদিন রিয়াজ হামিদুল্লাহ একটি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে লেখেন, পারস্পরিক আস্থা, মর্যাদা, প্রগতিশীলতা, সুফল ভাগাভাগি আর অভিন্ন মূল্যবোধের ভিত্তিতেই দুদেশের মানুষের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব।

ভারতে জুলাই বিপ্লবীদের ‘জঙ্গি’ আখ্যা দেওয়াসহ নানা ঘটনায় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালিন সরকার শুরু থেকেই নাখোশ। এমন পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের দৃঢ় অবস্থান নেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। যথারীতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানিয়ে দিয়েছেন, দিল্লির কোনো নসিয়ত শুনতে ঢাকা রাজি নয়। সরকার তার পথেই এগোচ্ছে। জুলাই বিপ্লবের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত ১৭ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়েছে। ভারত এখন পর্যন্ত গ্রাহ্য না করলেও বার বার হাসিনার প্রত্যর্পণ চেয়ে বাংলাদেশ ভারতের কাছে অনুরোধ জানিয়ে আসছে।

ঢাকা-দিল্লির এ অবস্থান অপ্রত্যাশিত নয়। গত বছর দেড়েকে বাংলাদেশে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ও ভারতে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের মধ্যে নানা ইস্যুতে পাল্টাপাল্টি রাষ্ট্রদূত তলব, পারস্পরিক দোষারোপ ও বিবৃতি জারির অসংখ্য ঘটনার মাঝে কিছু সংযোজনও অপ্রত্যাশিত নয়। আবার ফয়সালার রাস্তাও ক্ষীণ। এ উত্তেজনাকর সময়েই এবারের বিজয় দিবসে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ঢাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নাম প্রায় ১৫ বছর আগে বিএসএফের হাতে নিহত বাংলাদেশি কিশোরী ফেলানী খাতুনের স্মরণে ‘ফেলানী এভিনিউ’ নামকরণ করেছে। এর ক’দিন আগেই ঢাকায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি চালানো বন্দুকধারীদের ভারতে আশ্রয় নেয়ার ঘটনা। সেখানে হাসনাত আবদুল্লাহর ভারত যদি বাংলাদেশের শত্রুদের তাদের ভূখন্ডে আশ্রয় দিলে বাংলাদেশও ভারত-বিরোধী শক্তিগুলোকে আশ্রয় দিয়ে ‘সেভেন সিস্টার্স’ কে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার হুমকি। উত্তর-পূর্ব ভারত জাতীয় নিরাপত্তার জন্য দিল্লির চোখে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল একটি ইস্যু ু সেই আঙ্গিকে হাসনাত আবদুল্লাহ-র এই মন্তব্যকে ভারত খুবই ‘প্ররোচনামূলক’ বলে মনে করা স্বাভাবিক। ঘটনা একদিনে বা দুয়েকটি ইস্যুতে এখানে গড়ায়নি। যদিও এনসিপিসহ বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক ও সুশীল সমাজের নেতারা প্রকাশ্যেই ভারত ইস্যুতে নানা বক্তব্য দিচ্ছেন অহরহ।

এসব কিছুকে ছাপিয়ে এখন দুদেশের মধ্যে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে হাসনাত আব্দুল্লাহর বক্তব্য। এর আগে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে ‘কথা বলার ক্ষেত্রে মনোযোগী হওয়ার’ আহ্বান জানিয়েছিলেন। জবাবে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সিংয়ের ওই মন্তব্যকে ‘অযথার্থ’ এবং ‘শিষ্টাচার ও কূটনৈতিক সৌজন্যের প্রতি সম্মানজনক নয়’ বলে মন্তব্য করেছিল। চলতি বছরের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস চীন সফরে গিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্য বা 'সেভেন সিস্টার্সকে' ল্যান্ডলকড উল্লেখ করে বলেছিলেন, তাদের সমুদ্রের ব্যবহারের ক্ষেত্রেই বাংলাদেশই একমাত্র অভিভাবক। তখনো এর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন হিমন্ত শর্মা। তিনি বলেছিলেন ‘‘যারা নিয়মিতভাবে ভারতের ‘চিকেনস নেক’ নিয়ে হুমকি দেয়, তাদের মনে রাখা উচিত—বাংলাদেশেরও দুটি এমন সংকীর্ণ করিডর রয়েছে, যা ভারতেরটির তুলনায় ‘‘অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ’’।

এক্স-এ দেওয়া এক পোস্টে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘বাংলাদেশের দুটি নিজস্ব 'চিকেনস নেক' রয়েছে এবং দুটিই অত্যন্ত স্পর্শকাতর’’। অপেক্ষা এখন সামনের দিনগুলোর। বাংলাদেশে নির্বাচিত নতুন সরকার এলে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক নতুন বাঁক নেবে বলে মূল্যায়ন, অপেক্ষা, বিশ্লেষণ রয়েছে। তা দুদেশেই। বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে বলে বার্ষিক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেছিলেন দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী। তার মানে ভারত এখানে নির্বাচনের আবশ্যকতা দেখছে? এ ক্ষেত্রেও বরং বিপত্তি ব্যাপক। নইলে নির্বাচনের আগ মূহুর্ত্যে ভারত ভেজাল পাকাচ্ছে কেন? আর ভারত কোনোকালেই এখানে দেশ-টু-দেশ বা সরকার টু সরকার বা পিপল টু পিপল সম্পর্ক পাতেনি। তাদের যাবতীয় সম্পর্ক গড়ায় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সাথে। আর ব্যক্তি হিসেবে শেখ হাসিনার সাথে। এটা তাদের জন্য কৌশলগতভাবে লাভজনক। প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে শেখ হাসিনা নয়াদিল্লির স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি গ্রহণ করেছেন। বিশেষ করে সীমান্তে স্থীতিশীলতা ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে। প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে তিনি বলে গেছেন, ভারতকে যা দিয়েছি আজীবন মনে রাখতে হবে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ভারতেই আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাঁর মৃত্যুদণ্ডের রায় জটিল কূটনৈতিক সংকট তৈরি করেছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অন্যতম বড় বাণিজ্য অংশীদার। এ অঞ্চলে ভারতের রপ্তানি বাণিজ্যের কেন্দ্রও দেশটি। অপরদিকে বাংলাদেশও ভারতের কাঁচামাল, জ্বালানি ও ট্রানজিট রুটের ওপর নির্ভরশীল। গত এক দশকে ভারত ৮-১০ বিলিয়ন ডলারের নমনীয় ঋণ দিয়েছে। কিছু পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধাসহ রেলপথ স্থাপন হয়েছে। ভারতীয় গ্রিড ও বন্দর থেকে বিদ্যুৎ, তেল ও এলএনজি সরবরাহ হয়েছে। নিষ্ঠুর আরেক বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতকে ঘিরে বাংলাদেশের জনমতের ব্যাপক অবনতিও দৃশ্যমান।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট