বাংলাদেশের পায়ের নিচের মাটি কখন শক্ত হয় - এই প্রশ্নের উত্তর কেবল উন্নয়ন সূচক বা অবকাঠামোর ভেতর খুঁজলে ভুল করতে হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে একটি রাষ্ট্রের প্রকৃত শক্তি নির্ভর করে তার প্রতিরক্ষা সক্ষমতা ও কৌশলগত প্রস্তুতির উপর। উন্নয়ন তখনই অর্থবহ হয়, যখন তা রক্ষা করার ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে থাকে। অন্যথায় উন্নয়ন নিজেই দুর্বলতার তালিকায় পরিণত হয়।
স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশ অর্থনীতি ও অবকাঠামোকে রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রে রেখেছে, কিন্তু প্রতিরক্ষা খাত থেকেছে প্রায় উপেক্ষিত। সড়ক, সেতু, ফ্লাইওভার, বিমানবন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে আমরা ব্যস্ত থেকেছি; অথচ এসব অর্জনকে রক্ষা করার সামরিক ও কৌশলগত শক্তি গড়ে তোলার প্রশ্নটি বারবার পাশ কাটানো হয়েছে। এর ফলে আমরা একটি অসম রাষ্ট্রকাঠামোর দিকে এগিয়েছি, যেখানে দৃশ্যমান উন্নয়ন আছে, কিন্তু নিরাপত্তার ভিত্তি দুর্বল।
এই প্রেক্ষাপটে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিরক্ষা খাতে গুরুত্ব দেওয়ার উদ্যোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এটি কেবল নীতিগত সিদ্ধান্ত নয়, বরং একটি স্পষ্ট বার্তা- বাংলাদেশ আর কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না। এই পরিবর্তনই প্রতিবেশী ভারতের অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে বলে অনেকেই মনে করেন, কারণ দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে একটি প্রতিরক্ষা সক্ষম বাংলাদেশ মানেই আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন।
ইতিহাস আমাদের শেখায় যে প্রতিরক্ষা ছাড়া উন্নয়ন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ইউক্রেন অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে ইউরোপমুখী ছিল, কিন্তু প্রতিরক্ষা দুর্বল থাকায় আগ্রাসনের মুখে পড়ে। দক্ষিণ কোরিয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকেও প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়ে আজ একটি শক্ত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েল শুরু থেকেই জানত- তাদের অস্তিত্ব কেবল কূটনীতিতে নয়, বরং প্রতিরক্ষায় নির্ভরশীল। এসব উদাহরণ প্রমাণ করে যে প্রতিরক্ষা কখনো বিলাসিতা নয়; বরং অস্তিত্বের শর্ত।
বাংলাদেশকে কেন দীর্ঘদিন প্রতিরক্ষা খাতে দুর্বল রাখা হয়েছে- এই প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়া যায় না। স্বাধীনতার পর থেকেই এমন একটি রাষ্ট্রচিন্তা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, যেখানে সামরিক সক্ষমতা নিয়ে কথা বলাকে প্রায় অস্বস্তিকর করে তোলা হয়েছে। অর্থনীতি, সংস্কৃতি, উৎসব, পরিচয় নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে; কিন্তু প্রতিরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেই সেটিকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে। এই শূন্যতা কাকতালীয় নয়; বরং আঞ্চলিক রাজনীতির বাস্তবতার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত।
এখানে সংস্কৃতির প্রশ্নও গুরুত্বপূর্ণ। পহেলা বৈশাখ, মঙ্গল শোভাযাত্রা, চারুকলা, উদীচী, ছায়ানট কিংবা নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক বয়ান নিঃসন্দেহে আমাদের সমাজের অংশ। কিন্তু সমস্যা তখনই তৈরি হয়, যখন সংস্কৃতি কৌশলগত সচেতনতার জায়গা দখল করে নেয় এবং প্রতিরক্ষা ভাবনাকে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলে। বিশ্ব রাজনীতিতে সংস্কৃতি একটি কার্যকর সফট পাওয়ার, এবং এই শক্তি কখনো কখনো মনস্তাত্ত্বিক আধিপত্য তৈরির হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
আমরা যতই অবকাঠামো নির্মাণে গর্ব করি, বাস্তবতা হলো-প্রতিরক্ষা দুর্বল থাকলে এইসব স্থাপনা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতে সময় লাগে না। আধুনিক যুদ্ধে সেতু, বন্দর, বিমানবন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্রই প্রথম লক্ষ্যবস্তু হয়। কঠিন সত্য হলো, বাংলাদেশের বর্তমান অবকাঠামো ধ্বংস করতে একটি শক্তিশালী প্রতিবেশীর প্রয়োজন হবে খুব অল্প সময়, যদি প্রতিরক্ষা সক্ষমতা যথেষ্ট না থাকে। তখন উন্নয়ন আর সাফল্যের প্রতীক থাকে না; বরং ঝুঁকির মানচিত্রে পরিণত হয়।
প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করার অর্থ যুদ্ধের প্রস্তুতি নয়-এই সত্যটি বারবার স্পষ্ট করা প্রয়োজন। বরং শক্তিশালী প্রতিরক্ষা যুদ্ধের সম্ভাবনা কমায়, কারণ শক্ত রাষ্ট্রকে আক্রমণ করার আগে আগ্রাসী শক্তিকে বহুবার ভাবতে হয়। প্রতিরক্ষা মানে সীমান্ত নিরাপত্তা, আকাশ ও সমুদ্র সুরক্ষা, সাইবার নিরাপত্তা, গোয়েন্দা সক্ষমতা এবং প্রযুক্তিগত আত্মনির্ভরতা। এসব ছাড়া কোনো রাষ্ট্র স্বাধীনভাবে নীতি নির্ধারণ করতে পারে না।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন প্রতিরক্ষা খাতে হাত দেন, তখন সেটি অনেকের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে, কারণ এতদিন এই খাত উপেক্ষিত থাকায় তাদের কোনো সমস্যা হয়নি। দুর্বল বাংলাদেশ তাদের জন্য নিরাপদ ছিল। কিন্তু একটি আত্মমর্যাদাশীল, কৌশলগতভাবে সচেতন বাংলাদেশ প্রশ্ন তোলে- সীমান্ত হত্যা, নদীর পানি, বাণিজ্য বৈষম্য ও কূটনৈতিক চাপের বিষয়ে। এই প্রশ্নগুলোই আধিপত্যবাদী স্বস্তিকে চ্যালেঞ্জ জানায়।
বাংলাদেশ আজ একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আমরা কি কেবল অবকাঠামোর রাষ্ট্র হয়ে থাকতে চাই, নাকি একটি প্রতিরক্ষা সক্ষম, আত্মমর্যাদাশীল ও স্বাধীন সিদ্ধান্তগ্রহণকারী রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে দাঁড়াতে চাই? ইতিহাস বলে-যে রাষ্ট্র প্রস্তুত থাকে, সে টিকে থাকে। প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করা কোনো বিলাসিতা নয়; এটি সার্বভৌমত্বের ন্যূনতম শর্ত। প্রশ্ন হলো-আমরা কি সেই বাস্তবতা মেনে নেওয়ার সাহস দেখাতে পারব।
: লেখক ও সংগঠক
