আকাশে ফুলঝুরির রঙিন ছটা, রাস্তায় উল্লাসের গান নতুন বছরের এই উন্মাদনা বাংলাদেশের শহরগুলোকে যেন এক অদ্ভুত জাদুতে আচ্ছন্ন করে। কিন্তু এই আনন্দের পিছনে লুকিয়ে থাকে পরিবেশের গভীর ক্ষতি, যা বছরের পর বছর ধরে ক্রমবর্ধমান হয়ে উঠছে। ২০২৫ সালে ঢাকা ও অন্যান্য শহরে নববর্ষের উদযাপনের ফলে বায়ু দূষণ ৩০ শতাংশ বেড়েছে, শব্দ দূষণের অভিযোগ বুনিয়াদি স্তরে পৌঁছেছে এবং আইনের অবহেলা যেন একটি চিরকালীন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশবিদ এবং আইনজ্ঞরা সতর্ক করছেন: এবার ১ জানুয়ারি ২০২৬-এর স্বাগত জানানোর সময় এই ভুলগুলো থেকে বিরত থাকুন কারণ পরিবেশের ক্ষতি শুধু আজকের নয়, আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যতের।
২০২৫ সালের নববর্ষের উদযাপন (৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ রাত থেকে ১ জানুয়ারি ২০২৫ সকাল) বাংলাদেশের পরিবেশকে নতুন করে আঘাত করেছে। আইকিউএয়ারের তথ্য অনুসারে, ঢাকায় ১ জানুয়ারি সকালে এআইকিউ স্কোর ২৩১-এ পৌঁছেছে, যা 'খুবই ক্ষতিকর'ের স্তরে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা শীর্ষস্থান অধিকার করেছে। এর মূল কারণ? আতশবাজি এবং পটকা ফোটানো, যা থেকে নির্গত হয় সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড এগুলো বাতাসকে বিষাক্ত করে তোলে। গত তিন বছরের পরিসংখ্যান দেখায়, এই উদযাপনের পর বায়ু দূষণ ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, যা শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি এবং হৃদরোগের ঝুঁকি ৪০ শতাংশ বাড়ায়, বিশেষ করে শিশু এবং বয়স্কদের মধ্যে।
শব্দ দূষণের ক্ষতি আরও ভয়াবহ। ২০২৫-এর নববর্ষে জাতীয় জরুরি হেল্পলাইন ৯৯৯-এ শব্দ দূষণ নিয়ে ৩৬৫-এরও বেশি অভিযোগ এসেছে, যার মধ্যে ১৬০টি শুধু ঢাকা থেকে। আতশবাজির শব্দ ৮৫-৯০ ডেসিবেল ছাড়িয়ে যায়, যা পশু-পাখির জন্য মারাত্মক ঢাকায় একা ১০০-এর বেশি পাখি মারা গেছে বিভিন্ন প্রজাতির। ফানুস এবং আতশবাজির অবশিষ্টাংশ মাটি ও জল দূষিত করে, যা বুড়িগঙ্গা নদীর মতো জলাশয়গুলোতে টক্সিনের মাত্রা বাড়িয়ে জলজ জীবনের ধ্বংস ঘটায়। ডিসেম্বর ২৩-এ ঢাকার এআইকিউ ২৩১ ছিল, কিন্তু নববর্ষের পর এটি আরও খারাপ হয়েছে যা দেখায়, আমাদের শহরের দীর্ঘমেয়াদি দূষণ সংকটকে এই উদযাপন আরও গভীর করে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সতর্কতা সত্ত্বেও, ২০২৫-এ এই ক্ষয়ক্ষতি পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ১৯ শতাংশ বেড়েছে, যা জলবায়ু পরিবর্তন-সংবেদনশীল বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুতর হুমকি।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ধারা ৬ এবং নতুন করে জারি করা নয়েজ পলিউশন (কন্ট্রোল) রুলস ২০২৫ শহরাঞ্চলে অনুমতি ছাড়া আতশবাজি এবং উচ্চ শব্দ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই নিয়মে লাউডস্পিকার, মাইক্রোফোন এবং অ্যামপ্লিফায়ারের ব্যবহারের জন্য লিখিত অনুমতি বাধ্যতামূলক, এবং শব্দের সীমা ৯০ ডেসিবেল রাত ১০টার পর ৫৫ ডেসিবেলের বেশি নয়। ভঙ্গের শাস্তি? প্রথমবার ৫,০০০ টাকা জরিমানা, পরবর্তীতে ২ লক্ষ টাকা বা ২ বছরের কারাদণ্ড এমনকি ট্রাফিক পুলিশও এখন জরিমানা করতে পারে। কিন্তু ২০২৫-এ বাস্তবে কী ঘটেছে? পরিবেশ অধিদপ্তর মোবাইল কোর্ট চালালেও, শুধু কয়েকশ অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে যখন হাজারো লোক আইন ভেঙেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ক্রিসমাসের জন্য আতশবাজির নিষেধাজ্ঞা দিলেও (২৪ ডিসেম্বর ২০২৫ সন্ধ্যা থেকে ২৬ ডিসেম্বর ভোর), নববর্ষের রাতে এটি অক্ষরে মানা হয়নি। এই অবাধ্যতা শুধু পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, অ্যালকোহল অপব্যবহার এবং ড্রাঙ্ক ড্রাইভিংয়ের মাধ্যমে দুর্ঘটনার সংখ্যা ২০ শতাংশ বাড়িয়েছে, যা মোটর ভেহিকল আইনেরও ভঙ্গ। পরিবেশবিদ ড. সাইফুল আলম বলছেন, "২০২৫-এর এই ক্ষয়ক্ষতি আমাদের শিক্ষা আইন মানলে আমরা সকলে জয়ী হব।’’
এই ক্ষয়ক্ষতি থেকে বিরত থাকার উপায় আছে। ডিজিটাল ফায়ারওয়ার্কস অ্যাপ, লেজার শো বা অনলাইন কনসার্ট দিয়ে উল্লাস করুন বিনা দূষণে। পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ ব্যবহার করুন এবং আবর্জনা ব্যবস্থাপনা মেনে চলুন। সরকারের পক্ষ থেকে সচেতনতা ক্যাম্পেইন এবং কড়া প্রয়োগ জোরদার করা দরকার, যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ফায়ারওয়ার্কস নিষিদ্ধ করেছে। ২০২৬ সালে যদি আমরা এই শিক্ষা নিই, তাহলে নতুন বছর সত্যিই ‘নতুন’ হবে পরিবেশ-সমৃদ্ধ এবং আইনানুগ।
লেখক: শিক্ষার্থী
আইন বিভাগ, ফেনী ইউনিভার্সিটি
