একসময় যেখানে খালে বয়ে চলতো স্রোতের কলতান, সেখানে এখন গড়ে উঠেছে আবাসিক স্থাপনা, দোকানঘর কিংবা সড়ক। জেলার উত্তরের নদীমাতৃক উপজেলা ফুলগাজী, যার বুক চিরে একদিন শত খাল, ছড়া ও জলাধার প্রবাহিত হতো। সময়ের পরিক্রমায় এখন সেই জলের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে দখল-দূষণ ও অপরিকল্পিত নগরায়নে। এতে সামান্য বৃষ্টিতেই জনপদে জমে যায় হাঁটু পানি, ডুবে যায় মাঠ ও বাড়িঘর। দৈনিক ফেনীর প্রতিবেদনে পড়ুন উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নের চিত্র:
বিলীনের পথে আনন্দপুর ইউনিয়নে খালগুলো
উপজেলার প্রবেশদ্বার বন্দুয়া দৌলতপুর থেকে ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়কের দুই পাশ ধরে হাসানপুর পর্যন্ত বয়ে যাওয়া খালটি ছিল ইউনিয়নের প্রাণ। সেটির ৫০ শতাংশই এখন দখলে চলে গেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ইউনিয়নের চারটি খালের অস্তিত্ব এখন কোথাও কোথাও বিলীন হওয়ার ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। ১ দশমিক ২১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের আনন্দপুর খালের উৎস মুখ বন্দুয়া খালে। আবার হাসানপুর হতে উৎপত্তি হওয়া ২ দশমিক ৯৩ কিলোমিটারের বন্দুয়া খালটিও এখন অতীত। মাইজগ্রাম হাসানপুর মৌজায় উৎস স্থল ১ দশমিক ২১ কিলোমিটারের শফিউল্লাহ খালটি অনেক স্থান দখলে চলে যাওয়ায় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। শফিউল্লাহ খালটি বন্দুয়া দেশ ব্রিকস সংলগ্ন ফেনী-পরশুরাম সড়কে থাকা ব্রিজ হয়ে বয়ে যায়। ব্রিজের পাশে সরকারি জায়গায় বর্তমানে একটি মুড়ির কারখানা স্থাপন করায় খালটি বন্ধ হয়ে গেছে। বন্দুয়া ব্রিজ হতে আরেকটি নালা ফেনী-বিলোনিয়া পরিত্যক্ত রেলপথের ব্রিজের নিচ দিয়ে কচিয়া এলাকার কৃষি জমিতে গেলেও সেটি দখলে চলে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা এমদাদ চৌধুরী বলেন, এগুলো অনেকেই দখলে নিয়ে গেছে, আবার কিছু ভরাট হয়ে গেছে।
ইউনিয়নের সবচেয়ে দীর্ঘ ৯ কিলোমিটারের হাসানপুর খালের উৎস মুখ সিলোনিয়া নদীতে। এসব খালের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া এখন কঠিন হয়ে গেছে। এটি ইউনিয়নের উত্তরে ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়কের উত্তর আনন্দপুর সীমানায় গথিয়া ব্রিজ হতে ধোপাইছড়ি হয়ে হাসানপুর ও তালপুকুরিয়া দিয়ে ছাগলনাইয়া পাঠাননগর ইউনিয়নের কাছারি বাজারের পূর্ব দিকে সিলোনিয়া নদীতে মিলিত হয়। এই খালটিও এখন ধ্বংস প্রায়। খাল হতে ধোপাইছড়ি হয়ে একটি নালা জিএমহাটের নুরপুরে গিয়ে পৌঁছায়। একই খাল হতে বাইশ্যা ছড়া নামে পরিচিত আরেকটি নালা কাছারি বাজারে মিলিত হয়।
জিএমহাট সংলগ্ন নুরপুর থেকে কাছারি বাজার পর্যন্ত খাল একসময় গৃহস্থালির পানি নিষ্কাশন ও চাষাবাদে বড় ভূমিকা রাখতো। কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ, এখন সেখানে ভরাট করে বাড়িঘর করা হয়ে। কৃষক শাহ আলম বলেন, সামান্য বৃষ্টিতেই পাশের ধানের জমিগুলো পানিতে তলিয়ে যায়।
উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আঞ্চলিক সড়কের দুপাশে দেশ ব্রিকস থেকে তারুর দোকান পর্যন্ত ১ হাজার মিটার খননের আওতায় এলে কৃষি জমি সেচের আওতায় আসবে।
আনন্দপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক গোলাম রসুল মজুমদার গোলাপ বলেন, এসব খাল অনেক জায়গায় ভরাট হয়ে গেছে। এগুলো খনন করে কৃষকের জমি ও আশেপাশের বসতবাড়ির জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
মুন্সীরহাটে সেচের খাল দখলে, অচল ড্রেনেজ
পুরাতন মুন্সীরহাট বাজারের ড্রেনেজ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে পড়েছে বহুদিন। কমুয়া রোড ধরে গথিয়া খালে যে পানি যেতো, সেই পথ বন্ধ করে ভরাট করেছে প্রভাবশালী মহল। দক্ষিণ শ্রীপুরের যুবনেতা মো. বেলাল বলেন, ব্রিজ বন্ধ করে দেওয়ায় বৃষ্টির পানি আর নামতে পারে না। এতে দক্ষিণ শ্রীপুর গথিয়া খালের পাশে দক্ষিণ শ্রীপুর-কুতুবপুর গ্রামের পুরো ফসলি মাঠ পানিতে তলিয়ে যায়।
কমুয়া আবদুল জব্বার মাদ্রাসা রোডে অপরিকল্পিত বসতি তৈরির ফলে স্থায়ী জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। তারালিয়া খালের দখল এবং ভারত থেকে আসা তেতৈয়া ও মান্দারপুর ছড়ার গতিপথ বন্ধ হওয়ায় এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্যও নষ্ট হয়েছে।
কৃষি কর্মকর্তা মো. খোরশেদ আলম বলেন, মুন্সীরহাট ইউনিয়নের সিলোনিয়া-তারালিয়া খাল (সাবেক উলসি খাল) নোয়াপুর-তারালিয়া মাঠ থেকে সিলোনিয়া খাল পর্যন্ত। প্রায় দুই হাজার মিটার খনন করা হলে আমন মৌসুমে পানি নিষ্কাশন ও রবি মৌসুমে সবজি আবাদ এবং বোরো আবাদ বাড়বে।
আমজাদহাটে গৈরা খালের করুণ পরিণতি
ভারত থেকে প্রবাহিত গৈরা খালটি বাংলাদেশের ঋষ্যমুখ হতে শুরু হয়ে ফেনাপুস্করণী, উত্তর তারাকুচা, পূর্ব বসন্তপুর থেকে ছাগলনাইয়া-পরশুরাম সড়কের পশ্চিমাংশে মনিপুর গ্রামে প্রবেশ করে। মনিপুর থেকে এ গৈরা খাল দক্ষিণ ধর্মপুর দিয়ে মুহুরী নদীতে পতিত হয়। খালের মনিপুর অংশে দখলের কারণে বালু উত্তোলন করায় বর্ষার অবিরাম বৃষ্টিতে গৈরা খাল উপচে লোকালয় প্লাবিত হয়। গৈরা খালের দখল ও সরু হয়ে যাওয়ায় মনিপুর ও ইসলামপুরে পানিতে তলিয়ে যায় কৃষিজমি।
আমজাদহাটের উত্তরে তালবাড়িয়া খালটি হাড়িপুস্করণী থেকে শুরু হয়ে তালবাড়িয়া হয়ে মুহুরী নদীতে পতিত হয়েছে। সরু হয়ে যাওয়ায় খালের পানি ধারণ ক্ষমতা না থাকায় তালবাড়িয়ায় বিস্তীর্ণ এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা হাজী হাবিব বলেন, খালের দুই পাশে ঘরবাড়ি গড়ে উঠেছে। পানিও এখন স্যাঁতস্যাঁতে রূপ নিয়েছে। খালের উপর গড়ে ওঠা অবকাঠামোর কারণে বর্ষায় জলাবদ্ধতায় চরম ভোগান্তি হয়।
ইউনিয়নের দক্ষিণে ফেনা পুস্করিণী থেকে দক্ষিণ তারাকুচা দিয়ে ছাগলনাইয়া উপজেলার মনুরহাট ও পশ্চিম দেবপুর হয়ে মুহুরী নদীতে পতিত হয়েছে। আমজাদহাটের তালবাড়িয়ার করিম, মনিপুর গ্রামের বাসিন্দা কাসেম ও ঋষ্যমুখের রফিক বলেন, দ্রুত এসব খাল খননের আওতায় এলে জলাবদ্ধতা নিরসনসহ কৃষি জমি সেচের আওতায় আসবে।
উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, কহুয়া নদীর পূর্ব পাড় থেকে খাজুরিয়ার শেষ পর্যন্ত গজারিয়া খালটি খনন করা হলে পতিত জমিতে রবি শস্য ও বোরো ধান আবাদের আওতায় আসবে। এছাড়া উত্তর তারাকুচা নতুন পাতা নালির কূল পর্যন্ত এক কিলোমিটার গৈরাছড়া খালটি খনন হলে বোরো মৌসুমে সেচের আওতায় আসবে, এতে সবজি উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে।
দরবারপুরের খাল হারিয়েছে পরিচিতি
দরবারপুরের বসন্তপুর ও করইয়া এলাকায় খাল ও জলাধার একসময় স্থানীয় কৃষির মূল ভরসা ছিল। পানুয়া প্রান্তরের কৃষক রুহুল আমিন বলেন, এখন তো খালই চিনতে পারি না। জায়গাগুলোতে ঘের দিয়ে কেউ গাছ, কেউ বাড়ি করেছে। বসন্তপুর ও বশিকপুরে জলাধার থেকে গথিয়া খালে পানি যেতো, কিন্তু সেটিও এখন অতীত।
উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, তেলিয়াখাল পশ্চিম বসন্তপুর সংলগ্ন জাকারিয়ার বাড়ি থেকে জগৎপুরের উত্তর-পশ্চিম দিক পর্যন্ত এক কিলোমিটার খাল খননের আওতায় এলে ১০০ হেক্টর জমির পানি সহজে নিষ্কাশন হবে। এতে নতুন করে ৫০ হেক্টর ধান চাষের ও ৭ হেক্টর জমি সবজি-রবি শস্য আবাদের আওতায় আসবে।
ফুলগাজী সদরে নদ আছে, নেই নিষ্কাশন
সদরের মুহুরী নদীর পাশে থাকা গ্রাম নিলক্ষ্মী, গোসাইপুর, উত্তর শ্রীপুরে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় এসব এলাকা প্রতি বর্ষায় ডুবে যায়। ঘনিয়ামোড়া এলাকার বাসিন্দা মিজান বলেন, পাশেই মুহুরী নদী, অথচ জলাবদ্ধতা সারাবছর। কারণ এখানে নিষ্কাশনের পথ বন্ধ।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দুই হাজার মিটার দৈর্ঘ্যের নিলক্ষী পাথরের খাল (ছড়া) ও নিলক্ষী-দেড়পাড়া খাল দুটি সিলোনিয়া নদী পর্যন্ত খনন করা হলে আমন ও বোরো ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
ফুলগাজী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. খোরশেদ আলম বলেন, প্রাকৃতিক জলাধার না থাকলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বাড়ে। একইসাথে জলাবদ্ধতা কৃষির শত্রু হয়ে ওঠে। আমরা কৃষকের সাথেই আছি, তবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী আখতার হোসেন মজুমদার বলেন, মুহুরী প্রকল্পের খালগুলো ইতোমধ্যে খনন করা হয়েছে। উপজেলার ৭৯টি মৌজায় সবগুলো পাউবোর অন্তর্ভুক্ত নয়। অনেকগুলো স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতায় পড়েছে।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাশিয়াত আকতার বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশনায় প্রতিটি ইউনিয়নে খালের অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অভিযুক্তদের চিহ্নিত করার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এতে সাধারণ মানুষজনও সহযোগিতা করতে হবে।
এ ব্যাপারে ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহরিয়া ইসলাম বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে পরিকল্পিত খাল খনন, পুরোনো জলাধার ও অবৈধ দখল চিহ্নিত করে কাজ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। জনগণের সহযোগিতা পেলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।