ফেনীর ফুলগাজী উপজেলায় কৃষি জমির টপ সয়েল কাটার মহোৎসব কিছুতেই থামছে না। বিগত কয়েক বছর ধরে চলা এই অপতৎপরতা শীতকালীন শুষ্ক মৌসুমে আরও তীব্র হয়ে উঠছে। গত শনিবার (২০ ডিসেম্বর) রাতে দক্ষিণ দৌলতপুরে মাটিকাটা বন্ধে অভিযান পরিচালনা করেন বলে জানান সহকারী কমিশনার ভূমি সোহেলী নোশীন প্রত্যাশা। এসময় একটি স্কেভটর অকেজো করলেও পালিয়ে যাওয়ায় কাউকে আটক বা জরিমানা করা সম্ভব হয় নি।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে শতাধিক স্থানে প্রায় ২০০ জনেরও বেশি লোক এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। আসন্ন সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে প্রশাসনের ব্যস্ততার সুযোগ কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির মাটি ব্যবসায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছে রাতের আঁধারে মাটি কাটার। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যারা এই কাজে জড়িত ছিল, তাদের মাঠপর্যায়ের বিচরণ কিছুটা হ্রাস পেলেও, তারা এখন ভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়ে এবং নতুন মোড়কে ফিরে আসছে। এই পরিস্থিতিতে কৃষি জমির উর্বরতা হারানোর পাশাপাশি পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের উপর গুরুতর প্রভাব পড়ছে, যা জেলার খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই সমস্যা নতুন নয়। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, ফুলগাজীতে মাটি কাটার অভিযোগ বছরের পর বছর ধরে চলছে।

২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি তারিখে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ফুলগাজীর সদরের বৈরাগপুর, দক্ষিণ দৌলতপুর, ঘনিয়ামোড়া, মুন্সিরহাট ইউনিয়নের তারালিয়া, নোয়াপুর, বদরপুর, কতুবপুর এবং জিএমহাট ইউনিয়নের নুরপুর, শরীফপুর, আমজাদহাটে আবাদী জমির উপরিভাগের মাটি কাটা হয়। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছিলেন যে, এতে কৃষি উৎপাদন কমে যাবে এবং জমির উর্বরতা হারাবে। ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ আছে যে, ২০ ডিসেম্বর ২০২০-এ জিএমহাট ইউনিয়নের নুরপুরে মাটি কাটার ৩টি এস্কেভেটর এবং ৪টি ডেজার মেশিন জব্দ করা হয় সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে।

এই সমস্যা ২০২২-এও অব্যাহত ছিল। ২৮ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফুলগাজীর ছয়টি ইউনিয়নে প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রায় অর্ধশতাধিক মাটি ব্যবসায়ী স্থানীয় প্রভাবশালীদের যোগসাজশে এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবেদনে নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বিগত সরকারের সময়ে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক বদরপুরের এমরান, মাদারপুরের আবু মেম্বার, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মো. শামীম, পিন্টু, সালাউদ্দিন, মো. ইব্রাহিম এবং মুন্সিরহাটের কমুয়া পৈথারার মো. মূসা ও ফরিদের নেতৃত্বে এই মহোৎসব চালানো হয়। সে সময় কৃষক আবু তাহেরের উদ্ধৃতি ছিল যে, এতে রাস্তাঘাট এবং কৃষি জমি ধ্বংস হচ্ছে, এবং প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।

২০২৪ সালে সমস্যা আরও প্রকট হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪-এ ফুলগাজীর বসন্তপুরে মেসার্স আমজাদহাট ব্রিকস এবং বসন্তপুর ব্রিকসকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয় সাবেক উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাশিয়াত আক্তারের নেতৃত্বে, এবং কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪-এ আনন্দপুর ইউনিয়নে মেসার্স রুপালী ব্রিকসকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা এবং আংশিক ভাঙচুর করা হয়, যখন দেশ ব্রিকস এবং হাসানপুর ব্রিকস পুরোপুরি বন্ধ করা হয়। ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, ফেনীতে প্রতি বছর ইটভাটায় ৫ কোটি ঘনফুট মাটির চাহিদা মেটাতে ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে, এবং ইটের বিকল্প না থাকায় প্রশাসন উভয় সংকটে পড়েছে। সদ্য সাবেক জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম তখন বলেছিলেন যে, ফসলি জমির মাটি কাটলে মামলা এবং জরিমানা করা হবে।

২০২৫ সালে অভিযান আরও তীব্র হয়েছে। ১০ মার্চ ২০২৫-এ নোয়াপুর রোড, মুন্সিরহাটে মাটি কাটার অভিযোগে ১২টি ট্রাক এবং ২টি এস্কেভেটর আটক করা হয় সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানিয়া ভুঁইয়ার নেতৃত্বে, যা বাংলাদেশের ভূমি ও ফসলি জমির টপ সয়েল রক্ষা আইন ২০১৩-এর লঙ্ঘন। ১০ এপ্রিল ২০২৫-এ দরবারপুর ইউনিয়নের চকবস্তায় বিএনপি নেতা আবুল বশর এবং যুবদল কর্মী খোরশেদ আলমসহ স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মাটি কাটার অভিযোগ ওঠে। ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ আনন্দপুরে মেসার্স আনন্দরত্ন অটো ব্রিকসকে গুড়িয়ে দিয়ে ৭ লাখ টাকা জরিমানা করা হয় জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার জাহাঙ্গীর হোসাইনের নেতৃত্বে। মে ২২, ২০২৫-এ মুহুরী নদীর সেতুর নিচে মাটি কাটায় ফজলুল হক বলিকে ৭ দিনের জেল এবং ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয় সম্প্রতি বদলি হওয়া সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাশিয়াত আক্তারের নেতৃত্বে।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে যে, জেলায় ১০২টি ইটভাটার মধ্যে কাগজে-কলমে ৪৫টি বৈধ, কিন্তু বাস্তবে ৯০-৯২টি চলমান, যার মধ্যে মাত্র ৭-৮টির পরিবেশ ছাড়পত্র আছে।

ফুলগাজীতে অফিসিয়ালি ৭টি বৈধ এবং ১১টি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে, যা ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৮)-এর লঙ্ঘন। আনন্দপুর ইউনিয়নে একাই ৭টি ইটভাটা রয়েছে, যদিও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে সেখানে আবাদি জমি ৭৯৫ হেক্টর, জলাশয় মাত্র ৩০ হেক্টর।

বর্তমানে জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মিজ্ সংযুক্তা দাশ গুপ্তা জানিয়েছেন, ফুলগাজীতে ১০টি অবৈধ এবং ৭টি বৈধ ইটভাটা রয়েছে। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে ৮টি ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে ৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।

২০২৫ সালে ৭টি ইটভাটায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে এবং চিমনি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, পরিবেশ রক্ষায় কঠোর আইন প্রয়োগ করে এসকল মাটি দস্যুদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।

কৃষি বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, টপ সয়েল কাটলে জমির উর্বরতা ফিরে আসতে এক যুগ লাগে।

ফুলগাজী উপজেলার সাবেক কৃষি কর্মকর্তা মো. মাসুদ রানা ইতোপূর্বে জানিয়েছেন, উপরিভাগের ৬-৭ ইঞ্চি মাটিতে সব জৈব গুণাগুণ থাকে, এবং এটি কাটলে উৎপাদন হ্রাস পায়। ইটভাটার ধোঁয়া ও ছাইয়ের কারণে ধান, শাক-সবজি নষ্ট হয় এবং মানুষের স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোঃ খোরশেদ আলম জানান, আমন ধান কাটার পরে কৃষি জমির মাটি কাটার হিড়িক পড়ে যায়। তিনি বলেন, এক ফসলি জমি বা নীচু, ডোবা এলাকার জমি বা পতিত জমির মাটি কাটা যাবে। দু বা তিন ফসলি জমির মাটি কাটা যাবে না। কারণ এসব জমির উপরিভাগে জমির পুষ্টি উপাদান টপসয়েলে থাকে। এসব জমির মাটি কাটা হলে পরবর্তী সময়ে উৎপাদন হ্রাস পাবে।

১০৪৯২ হেক্টর আয়তনের এই উপজেলায় এক, দু বা তিন ফসলি আবাদি জমি ৬৫০০ হেক্টর। তন্মধ্যে ফসল উৎপাদন হয় ৬২৬৭ হেক্টর। বাকি ২৩৩ জমিতে পানি সংরক্ষণ বা রাস্তার পাশে কিংবা মামলা জনিত কারণে উৎপাদনে আসে নি। কৃষি কর্মকর্তা জানান উপজেলায় অনাবাদি বা পতিত জমি ২৩৩হেক্টর। এই অনাবাদি জমিতে বরো ধানের উৎপাদন বা পানি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না। এসব অনাবাদি বা পতিত জমির ১২০ হেক্টর আমজাদহাট ইউনিয়নে। বাকি ৫ ইউনিয়নে সামান্য পরিমাণ হতে পারে।

কৃষি কর্মকর্তা জানান, জমির মাটি কাটার জন্য আইনানুসারে ইউএনও’র নিকট আবেদন করলে অনুমতি সাপেক্ষে মাটি কাটা হয়।আবাদি কৃষি জমির উপরিভাগ কেটে ফেললে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। এসব মাটি ইটভাটায় নেয়া শাস্তিমূলক অপরাধ। কৃষি কর্মকর্তা জানান, প্রতি ইউনিয়নে কৃষি সহকারী কর্মকর্তা রয়েছে। কৃষককের অভিযোগের ভিত্তিতে কৃষি উপ-সহকারী কর্মকর্তার মাধ্যমে ফসলি জমির মাটি কাটা বন্ধ করতে উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটকে জানানো হলে যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

এ প্রসঙ্গে ফুলগাজী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সোহেলী নোশীন প্রত্যাশা বলেন, এ ক্ষেত্রে প্রশাসন জিরো টলারেন্স নীতি বজায় রাখার কৌশল নিয়েছে।

এই অব্যাহত দস্যুতা বন্ধে কঠোর অভিযান এবং সচেতনতা অপরিহার্য। প্রশাসনের জিরো টলারেন্স নীতি এবং কঠোর আইন প্রয়োগের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হলে ফসলি জমি রক্ষা সম্ভব হবে, অন্যথায় ফেনীর কৃষি অর্থনীতি অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে।