সোনাগাজীতে আবুল হাশেম (৫০) নামে এক ব্যক্তিকে মধ্যযুগীয় কায়দায় পিটিয়ে, কুপিয়ে বাম হাত ও পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করা হয়েছে। মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) ভোর সাড়ে ৫টার দিকে চরছান্দিয়া ইউনিয়নের ওলামা বাজার সাজেদা ফাউন্ডেশন সংলগ্ন সড়কের ওপর এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ঘটে।
নিহত আবুল হাশেম উপজেলার চরদরবেশ ইউনিয়নের দক্ষিণ চরদরবেশ হাদা ব্যাপারীর দোকান এলাকার আব্দুর শুক্কুরের ছেলে এবং পেশায় একজন কৃষক। সে ২০২১ সালে কৃষক বেলায়েত হোসেন বেলালকে কুপিয়ে-পিটিয়ে হত্যা মামলার প্রধান আসামি।
তার স্বজনদের দাবি, পূর্ব শত্রুতার জের ধরে প্রায় ৪ বছর আগে নিহত কৃষক বেলালের পরিবার পরিকল্পিতভাবে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
নিহতের ভাতিজা শেখ ফরিদ জানান, তার কাকা মহিষের দুধ সংগ্রহ করতে ভোরে মোটরসাইকেলে করে সাহেবের ঘাট ব্রিজ এলাকায় যাচ্ছিলেন। পথে ওলামাবাজার এলাকায় হামলার শিকার হন। তিনি আরও জানান, মৃত্যুর আগে হাশেম কয়েকজন হামলাকারীর নাম বলে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে রাসেল নামের একজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন সৈয়দ আহমেদের ছেলে আকতার হোসেন (৩৫), আবু সুফিয়ানের ছেলে জিয়া (২২), হাফেজ (৩৫), নুর ইসলামের ছেলে আমির হোসেন ওরফে ননা মিয়া (৩৫), ইসমাইলের ছেলে মো. সুমন ওরফে টিটু (২৮), মানিকের ছেলে শিফন (৩০), নুর ইসলামের ছেলে মাসুদ (২৬), ইউসুফের ছেলে রুবেলসহ (২৮) অন্তত আরও ২৫ জন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বোরকা পরিহিত ৮ থেকে ১০ জন দুর্বৃত্ত পূর্বপরিকল্পিতভাবে ওলামা বাজার এলাকায় তার পথরোধ করে। তারা সড়কের উভয় পাশের বৈদ্যুতিক পিলারে সবুজ রঙয়ের রশি বেঁধে সড়কে প্রতিবন্ধককা তৈরি করে। ফজরের নামাজের পর ওলামাবাজারের দিক থেকে মোটরসাইকেলে আবুল হাসেম ঘটনাস্থলে পৌঁছলে রশি দেখে থেমে যায়। এসময় বোরকাপরা দুর্বৃত্তরা সড়েকের পাশ থেকে বেরিয়ে আবুল হাসেমকে এলোপাথাড়ি কোপাতে থাকে। এসময় ধারালো অস্ত্র দিয়ে বাম হাত ও পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয় এবং মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত করে গুরুতর জখম করা হয়। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করে মরদেহ মর্গে পাঠান।
স্থানীয় সূত্র জানায়, জমিজমা ও পারিবারিক আধিপত্যকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে খুন হওয়া আবুল হাশেমের পারিবারের সাথে একই গ্রামের হাদা ব্যাপারী পরিবার ও ননা মিয়া পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছিল। দ্বন্দ্বে তাদের মধ্যে একাধিক পাল্টাপাল্টি মামলাও চলমান। ২০২১ সালের ৩১ মে ভোরে কৃষক বেলাল ও তাঁর ভাই মাসুদ বাড়ির পাশে মহিষের দুধ সংগ্রহ করতে যান। এ সময় দুই ভাইকে কুপিয়ে-পিটিয়ে জখম করা হয়। পরে দুই ভাইকেই ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে বেলালকে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এই হত্যাকান্ডের জন্য ননা মিয়া বাদি হয়ে আবুল হাসেম, তার পিতা আব্দুস শুক্কুরসহ ৭ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। দীর্ঘ তিন বছর কারাভোগের পর তিনি জামিনে মুক্তি পান এবং সোনাগাজীর মুহুরী সড়কের একটি ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন আবুল হাশেম।
স্থানীয় সূত্রে আরো জানা যায়, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন হাদা ব্যাপারি পরিবারের আবু সুফিয়ান মেম্বারসহ কয়েকজনকে পিটিয়ে গুরুতর জখন করে দুর্বৃত্তরা। এই ঘটনার জন্য হাদা ব্যাপারি পরিবার আবুল হাশেমকে দায়ী করলেও নিরিপত্তাজনিত কারনে মামলা করেনি। এদিকে গত কয়েকমাস আগে ননা মিয়াকে ফেনীতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হতাহতের তিনটি মামলায় র্যাব গ্রেপ্তার করে। জামিনে মুক্তি পেয়ে ননা মিয়া তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্য আবুল হাশেমকে দায়ী করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিন পক্ষের বিরোধ গত কয়েকমাস চরম আকার ধারণ করে।
সোনাগাজী উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন সেন্টু বলেন, হাশেম আমাদের দলের সক্রিয় সমর্থক ছিলেন। কোনো পদে না থাকলেও মিছিল-মিটিংয়ে নিয়মিত অংশ নিতেন। ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরেই তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করি।
সোনাগাজী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. বায়েজীদ আকন বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, পূর্ব বিরোধের জেরেই এ হত্যাকাণ্ড। রাসেল নামের একজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। নিহতের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ফেনী জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এ ঘটনায় এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।