সোনাগাজী উপকূলে ফেনী নদীতে কাক্সিক্ষত ইলিশ মাছ মিলছে না জেলেদের জালে। সাগরে মোহনায় ভিন্ন জেলার জেলেদের নির্বিচারে নিষিদ্ধ জাল ব্যবহারের কারণে দিন দিন আশঙ্কাজনকহারে ইলিশের পরিমান কমছে বলে জানিয়েছে সোনাগাজী উপকূলের জেলেরা।
সোনাগাজীর চর খন্দকার, মুহুরি প্রজেক্ট ও মুছাপুরের জেলেরা জানিয়েছেন, ১০ বছর আগেও ৬০ থেকে ৮০ কেজি ইলিশ মাছ নিয়ে প্রতিটি নৌকা পাড়ে ভিড়তো। এখন গড়ে ৭-৮ কেজি ইলিশ নিয়ে জেলেপাড়ার ঘাটে ভিড়ছেন সোনাগাজী জেলেরা। আবার কোন কোন দিন ইলিশের দেখাও পাওয়া যায় না। এতে নৌকার সামগ্রিক খরচও উঠে আসে না।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তাছলিমা আকতার বলেন, দপ্তরে সংরক্ষিত তথ্য হতে জেনেছি এখানে পর্যাপ্ত ইলিশ পাওয়া যেতো এবং ধীরে ধীরে ইলিশের পরিমান কমেছে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখলাম, ফেনী নদী হয়ে মোহনায় সোনাগাজীর যেসব জেলে মাছ ধরেন তাদের জালে বড় ইলিশ পাওয়া যায় না বললেই চলে, পেলেও খুবই অল্প সংখ্যক (১-৩টি) হবে। গত এক বছরে এ নদীতে ইলিশ ধরা পড়েছে ২শ কেজি। তিনি আরো জানান, সোনাগাজীতে নিবন্ধিত জেলে রয়েছে ২০৯৫জন। এরমধ্যে ২৪৫ জন ইলিশ জেলে এবং সাগরগামী ৩৪৫জন জেলে রয়েছে।
ইলিশ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে জেলে সর্দার সুধাংশু, জেলে সুদাম, জেলে প্রিয়নাথ বলেন, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর জেলেদের ২শ থেকে ৩শ নৌকা নিয়মিত সাগরের মোহনায় থাকে। তাদের প্রত্যেকে সমপরিমান জাল পানিতে ফেলে রাখে, এরমধ্যে বেশিরভাগ নিষিদ্ধ জাল দিয়ে রেনু ও জাটকাসহ ইলিশ ধরা হয়। এতে ইলিশ উৎপাদন কমে গিয়েছে এবং যা মাছ অবশিষ্ট থাকে তারাই ধরে নিয়ে যায়। ফলে সোনাগাজীর জেলেরা মাছ পাচ্ছে না।
নিখিল, শিপন, পিন্টু, জয়দেব নামে জেলেরা ইলিশ জাল দিয়ে মাছ ধরেন। তারা বলেন, ইলিশ রেনু জালে উঠলেও আমরা ফেলে দিই। বারবার জালে উঠাতে অনেক রেনু মারা যায়। তবে বহিরাগতরা কারেন্ট জালসহ নিষিদ্ধ জাল নিয়মিত বসিয়ে জাটকাসহ ছোট মাছগুলো নিধন করছে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তাছলিমা আকতার জানান, ইকোনমিক শিল্পাঞ্চলের কারখানা ও নতুন নতুন মৎস্য প্রকল্প গড়ে ওঠার কারণে নদীতে প্রচুর পলিমাটি জমা হচ্ছে। এতে ইলিশসহ অন্যান্য মাছের জীবনচক্রে উপযুক্ত পরিবেশ কমে আসছে। পাশাপাশি নদীর বাস্তুতন্ত্র পরিবর্তন হচ্ছে।
বহিরাগত ও নিষিদ্ধ জালের বিষয়ে মৎস্য কর্মকর্তা আরো বলেন, কারেন্ট জাল-বেহুন্তি জাল, মশারি জালসহ নিষিদ্ধ জাল ব্যবহারের কারণে শুধু ইলিশ মাছ নষ্ট হয় না, জীব বৈচিত্র্যও ধ্বংস হচ্ছে। সমুদ্রে মাছ ধরা দেশের সব জেলের জন্য উম্মুক্ত, তবে নিষিদ্ধ জাল জব্দ করতে আমাদের অভিযান অব্যহত থাকবে।
নিষিদ্ধ জাল ও রেণু সংগ্রহে কমছে মাছ
এক সময় সোনাগাজীর উপকূল থেকে ৩০ প্রজাতির বেশি মাছ পাওয়া গেলেও নানা প্রতিকূলতায় কমছে সামুদ্রিক মাছ। জেলে ও মৎস্য বিভাগের মতে, ফেনী নদী ও মোহনায় বর্তমানে ১২-১৫ প্রজাতির মাছ নিয়মিত পাওয়া যাচ্ছে। আবার কিছু প্রজাতি নিয়মিত পাওয়া না গেলেও কদাচিৎ জালে উঠে আসে, এর পরিমান খুবই অল্প সংখ্যক।
নদীর বিভিন্ন স্থানে গিয়ে দেখা যায়, জেলেরা নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল, বেহুন্তি, মশারি ও ঠেলা জাল দিয়ে মাছ আহরণ করছে। এতে রেনু-পোনা মাছ নিধনের পাশাপাশি ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
জেলে ও মৎস্য বিভাগ জানায় ইলিশ, ট্যাংরা, মাগুর, পাঙ্গাশ, চিংড়ি, পোয়া, বাইলা, খোরোল বাটা, চাপিলা, শাপলা পাতা মাছ, আইল, কোরালসহ কয়েক প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। এরমধ্যে কিছু মাছ সবসময় পাওয়া গেলেও সব প্রজাতির মাছ নিয়মিত পাওয়া যায় না। ইলিশ, শাপলা পাতা মাছ, আইল, কোরাল মাঝেমধ্যে জালে উঠে আসে। এসব মাছ দিন দিন কমছে।
এপ্রসঙ্গে চরখন্দকার জেলে পাড়ার জেলেসর্দার আফসার মহাজন বলেন, ৭-৮ বছর ধরে বড় ফেনী নদীর মোহনায় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও বরিশালের জেলেরা নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ব্যবহার করে মাছ ধরেছে। এতে রেনু ও পোনামাছ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এদের কারণে গত তিন বছর ধরে সোনাগাজীর জেলেরা ইলিশ মাছ পাচ্ছে না। যতদিন যাচ্ছে উপকূল থেকে মাছ কমছে। আমরা চাই মাছ রক্ষায় প্রশাসন এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিক।
এবিষয়ে মেরিন ফিশারিজ অফিসার মোঃ খায়রুল বাসার বলেন, সমুদ্র উপকূলীয় ফেনী নদীর বিভিন্নস্থানে ও সাগরের মোহনায় নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ও বেহুন্তি জাল দিয়ে রেনু-পোনা মাছ ধরছে জেলেরা। এতে জীব বৈচিত্র্যও ধ্বংস হচ্ছে। আমরা সারাক্ষণ পাহারা দিয়ে তো রাখতে পারি না। তবে আমরা নিয়মিত জেলেদের সচেতন করতে ক্যাম্পেইন ও অভিযান পরিচালনা করে আসছি।