সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বর্জ্য ও পৌর এলাকার আবর্জনা দক্ষিণ চরদরবেশ এলাকার উম্মুক্ত স্থানে অপরিকল্পিতভাবে স্তুপ করা হচ্ছে। ফলে চরম বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পৌরসভার ময়লা-আবর্জনা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ও উম্মুক্ত লেক-কৃষি জমিতে ফেলায় পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, দুর্গন্ধ, ধোঁয়া ও দূষণসহ রোগব্যাধিতে জীবনযাপন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ।

সোনাগাজী পৌরসভা সূত্র জানায়, বর্জ্য অপসারণে ৫০ জনের অধিক লোকবল প্রয়োজন থাকলেও বর্তমানে রয়েছে মাত্র ১৮ জন। প্রতিদিন পৌর এলাকায় প্রায় ৪০ টন বর্জ্য সৃষ্টি হচ্ছে, অথচ সোনাগাজী পৌরসভায় যে জনবল ও পরিবহন সক্ষমতা রয়েছে তাতে সর্বোচ্চ ২৫ টন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করা সম্ভব। তবে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র, পৌরসভার সকল এলাকায় নিয়মিত বর্জ্য অপসারণ করা হয় না।

সরজমিনে দেখা যায়, চরদরবেশ ইউনিয়নের দক্ষিণ চরদরবেশ এলাকার নুরানীবাজার থেকে আদর্শগ্রামে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেঁড়ি বাঁধ সড়কের পাশে লেক ও কৃষি জমিতে বর্জ্য ফেলছে সোনাগাজী পৌরসভার পরিচ্ছন্নতায় নিয়োজিতরা । খোলা স্থানে বর্জ্যস্তুপের কারণে দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। আশপাশের পানি ও বায়ু দূষণের ফলে উৎকট দুর্গন্ধে চরম বিপাকে পড়েছেন স্থানীয়রা। বর্ষার মৌসুমে বৃষ্টির পানির সাথে ময়লা আবর্জনার নিষিদ্ধ প্লাস্টিক, হাসপাতালের বিষাক্ত বর্জ্য কৃষি জমিতে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে কৃষক ও স্থানীয়রা। পুরো এলাকায় শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছে বসবাসরত মানুষ। নুরানীবাজার থেকে আদর্শগ্রামে বেঁড়ি বাঁধ সড়কটি দুই গ্রামের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষার্থী এবং এলাকার মানুষের যাতায়াতের একমাত্র পথ হওয়ায় স্থানীয়রা প্রকট সমস্যায় পড়েছেন বলে জানান একাধিক ব্যক্তি।

গ্রামের কৃষক মাসুদ আলম অভিযোগ করে বলেন, পৌরসভার বর্জ্য আমাদের এলাকায় ফেলা তাদের অপরাধ। ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের উপর ময়লা আবর্জনা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই মৌসুমে ধানের চারা রোপণ করতে পানিতে নামায় শরীরের বিভিন্ন অংশে ছোট ছোট বিচি ও চর্মরোগ দেখা দিয়েছে। আমরা ধান রোপণের সময় হাতে-পায়ে তেল ও ঔষধ লাগিয়ে নামলেও কাজ হচ্ছে না। এই এলাকার অর্ধশতাধিক কৃষক ১০ একর জমিতে ফসল উৎপাদনে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন।

চর্মরোগে আক্রান্ত পিযুস দাস বলেন, এভাবে ময়লা ফেলার কারণে আমার মতো শতাধিক লোক চুলকানি ও চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছে। বাতাস ও পানির মাধ্যমে পুরো এলাকায় জীবাণু ছড়িয়ে মানুষ অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। আমরা চাই এখানে আর বর্জ্য না ফেলা হোক এবং আবর্জনাগুলো দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে।

স্থানীয় বাসিন্দা জাবেদ হায়দার বলেন, ‘ময়লা ফেলার কারণে গন্ধে আমরা বাড়ি-ঘরে থাকতে পারছি না। খেতে বসলেও দুর্গন্ধ লাগে। অনেক সময় মরা জীবজন্তুর দেহ এখানে খোলা স্থানে ফেলা হয়। গন্ধের কারণে টিকতে না পেরে আমরা ময়লা ফেলতে এখন বাঁধা দিচ্ছি। এখানে ময়লা-আবর্জনা ফেললে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলব।’

ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী (পুর) মোঃ আবু মুসা রকি বলেন, আমাদের পুরনো অফিস কলোনীতে দীর্ঘদিন পৌরসভা বর্জ্য ফেলে স্তুপ করে রেখেছে। এখন ফেলা বন্ধ হলেও আগের বর্জ্যগুলো অপসারণ করা হয়নি। একাধিকবার আইনশৃঙ্খলা সভায় বলা হলেও কেউ কর্ণপাত করেনি এবং সিদ্ধান্ত দেননি। এভাবে সরকারি বাংলা ও অফিসে বর্জ্য ফেলা মেনে নেওয়া যায় না। এখন আবার পাউবোর বেঁড়ি বাঁধ এলাকা ও আমাদের জায়গায় বর্জ্য ফেলার বিষয়ে আমাদের সাথে কোন আলোচনা করা হয়নি। এ প্রসঙ্গে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করবো।

পাউবোর এই কর্মকর্তা আরও বলেন, সোনাগাজী পৌরসভায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। এজন্য পৌরসভার নাগরিকদের সচেতনতা প্রয়োজন। পাশাপাশি ঘনবসতি নেই অথবা ফাঁকা স্থানে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে হবে। সোনাগাজী উপজেলার চরাঞ্চলে অনেক খালি জায়গা আছে যেখানে এটি তৈরি করা হলে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষা পাবে।

উল্লেখ্য ২০২২ সালের ২২ মার্চ দৈনিক ফেনীতে পৌরসভার আবর্জনায় সোনাগাজী ওয়াপদা কলোনী ময়লার ভাগাড় শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হলে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়।
ফেনী পরিবেশ অধিদপ্তরের সিনিয়র কেমিস্ট মোঃ তানবীর হোসেন বলেন, সোনাগাজী পৌরসভার বর্জ্য উম্মুক্ত ও ওয়াপদা কলোনির ভিতরে ফেলার কারণে ২০২২ সালে আমাদের পক্ষ থেকে পরিবেশ বিপর্যয়ের মামলা করা হয়। পরে প্রশাসন তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় সেটি এখন রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে। বর্তমানে তারা জনবসতিপূর্ণ এলাকায় খোলা স্থানে বর্জ্য ফেলছে। এজন্য আশপাশের বসতবাড়িসহ মানুষের ক্ষতি হচ্ছে। পৌরসভার নির্দিষ্ট ডাম্পিং জোন না থাকায় এক জায়গায় নিষেধ করলে ফের অন্য জায়গায় ফেলে। এতে সমস্যা থেকেই যায়, দ্রুত ডাম্পিং এর ব্যবস্থা করতে হবে এবং পরিবেশ বিপর্যয় রক্ষায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন।

সোনাগাজী পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিদর্শক (কনজারভেন্সি ইন্সপেক্টর) সাইফুল ইসলাম স্বপন বলেন, পৌরসভা সৃষ্টি পর থেকে গত ২৩ বছর ধরে সোনাগাজীতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। এর প্রধান কারণ পৌরসভার মালিকানাধীন কোনো জায়গা নেই, যেখানে ডাম্পিং জোন তৈরি করা যায়। স্থায়ীভাবে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তৈরির জন্য দীর্ঘদিন ধরে জায়গা খোঁজা হলেও এখনো পাওয়া যায়নি।

এই প্রসঙ্গে সোনাগাজী নির্বাহী কর্মকর্তা রিগ্যান চাকমা বলেন, পৌরসভার নিজস্ব জায়গা না থাকায় বিগত এক বছর ধরে দক্ষিণ চরদরবেশ এলাকায় বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। আমরা আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ডাম্পিং জোন তৈরি করার জন্য স্থায়ী জায়গা খুঁজছি। জায়গা পাওয়া পর্যন্ত দক্ষিণ চরদরবেশ এলাকার বর্জ্য ফেলতে হবে।

 


দুই যুগেও হয়নি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

সোনাগাজী পৌরসভা প্রতিষ্ঠার প্রায় ২৩ বছর হলেও সোনাগাজী পৌরসভায় এখনও গড়ে ওঠেনি একটি আধুনিক ও পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। পৌর শহরের যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনায় দুর্গন্ধ, পরিবেশ দূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভুগছেন পৌরবাসী। দ্রুত ডাম্পিং স্পট নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন তারা।

জানা যায়, ২০০২ সালে সোনাগাজী ‘গ’ শ্রেণির পৌরসভা হিসেবে যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ‘খ’ শ্রেণিতে উন্নীত হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রথম শ্রেণির পৌরসভা হিসেবে ঘোষিত হলেও বর্জ্যের বোঝা পৌরবাসীর উপর চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সর্বশেষ দুই মেয়াদের মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা রফিকুল ইসলাম খোকন নিজ ক্ষমতাবলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা দখলে নিয়ে, ওয়াপদার সীমানা প্রাচীরের মধ্যে পৌরসভার সমস্ত বর্জ্য ফেলে স্তুপ গড়ে তোলেন। এ নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর মেয়রকে বিবাদী করে ফেনীর পরিবেশ আদালতে মামলা করেন। মামলাটি এখনো বিচারাধীন। পৌর কর্তৃপক্ষ প্রথমে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা দখলে নিয়ে বর্জ্য ফেললেও সেখানে বাঁধাগ্রস্ত হয়ে বর্তমানে চরদরবেশ ইউনিয়নের নুরানীবাজার থেকে আদর্শগ্রাম বেঁড়ি বাঁধ সড়কের পাশে পাউবোর জায়গায় উম্মুক্তভাবে ফেলছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বাসাবাড়ি, দোকানপাট, হোটেল, এমনকি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বর্জ্য রাস্তার উপরসহ যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে। ফলে ময়লা-আবর্জনার শহরে পরিণত হয়েছে সোনাগাজী পৌরসভা। বর্জ্য পদার্থকে রাস্তার পাশে যেখানে-সেখানে স্তুপ করে রাখা হচ্ছে, এতে পথচারীদের নাক চেপে হাঁটতে হয়। দিনের বেলা ও সন্ধ্যার পর সড়কের পাশে বিভিন্ন স্থানে ময়লার স্তুপ থাকায় পথচারীদের বর্জ্য ডিঙ্গিয়ে অথবা সোজা পথ এড়িয়ে হাঁটতে হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বছরের পর বছর ধরেই চলছে এমন অব্যবস্থাপনা। এতে পরিবেশ দূষণ, স্বাস্থ্য সমস্যা এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে।

পৌর বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী ইলিয়াস হোসেন বলেন, আমরা পৌরসভার বিপরীত পাশে যেসব ব্যবসায়ী রয়েছি, আমাদের দোকানের সামনে স্তুপ আকারে ময়লা আবর্জনা পড়ে থাকলেও নিয়মিত পরিষ্কার হচ্ছে না। পৌরসভার পক্ষ থেকে সপ্তাহে সর্বোচ্চ দুই দিন ময়লা নিয়ে যায়। এর মধ্যে ময়লা আবর্জনা পচে-গলে বাতাস মারাত্মক দূষিত করে। বৃষ্টিতে এ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। অপরিচ্ছন্নতার চিত্র পুরো জিরোপয়েন্ট এলাকায়ও দেখা যায়।

জিরো পয়েন্টসহ বিসমিল্লাহ মঞ্জিলের মালিক বাহার ও বাখরিয়া নাহার মঞ্জিলের মালিক ইসমাইল বলেন, আমাদের বাসা বাড়ি থেকে সাপ্তাহে ২ দিন ময়লা নিয়ে যায় পৌরসভা। পৌর কতৃপক্ষ প্রতিদিন ময়লা না নেওয়ায় ড্রামগুলোতে সবকিছু পচে পোকা হয়ে যায়। পাশাপাশি সোনাগাজী পৌরসভার বেশির ভাগ এলাকায় বর্জ্য পদার্থকে রাস্তার পাশে এখানে-সেখানে স্তূপ করে রাখতে দেখা যায়। আমরা বারবার পৌরসভাকে এসব সমস্যা সমাধান করতে বললেও তারা কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

জনস্বাস্থ্যেও এর গুরুতর প্রভাব পড়ছে বলে উল্লেখ করে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার এজিএম রায়হান বলেন, ময়লা আবর্জনায় ধরালো, ক্যামিকেল এবং পচা জিনিস থাকে। যত্রতত্র ময়লা পড়ে থাকার কারণে কোন না কোনভাবে মানুষ আক্রান্ত হয়। আমরা সাম্প্রতিক সময়ে সংক্রমণে রোগী বেশি পাচ্ছি। এর উল্লেখযোগ্য কারণ, ময়লা-আবর্জনা। পাশাপাশি সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বর্জ্য ধ্বংসের প্রক্রিয়া না থাকায় সেগুলো পৌরসভার নিয়ে যায়। এগুলো উম্মুক্ত পরিবেশে ছড়িয়ে পড়লে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হবেই।