ইলিশ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে ফের নদীতে মাছ শিকারে নেমেছে সোনাগাজী উপকূলের জেলেরা। গত ৪ অক্টোবর হতে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত নদী ও সাগরে মাছ শিকারে এ নিষেধাজ্ঞা। এ সময়ে সোনাগাজীর দুই হাজারেরও বেশি জেলে সরকারি নির্দেশনা মেনে নদী ও সাগরে মাছ ধরা বন্ধ রেখেছিল। জেলেরা নির্দেশনা মানলেও সরকারের কাছে তাদের দাবি ও অভিযোগ দীর্ঘ বছরেও দুর্ভোগ ও শোষণের অবসান ঘটেনি—এমন অভিযোগ করেছেন সোনাগাজীর জেলেরা।

জেলেদের অভিযোগ, গত কয়েক বছর ধরে ফেনী নদীর মাহনায় গিয়ে অন্য জেলার জেলেদের নিষিদ্ধ জালের দৌরাত্ম্যে তারা জাল ফেলতে পারছেন না। এমনকি বৈধ জাল ফেললেও আশানুরূপ ইলিশসহ অন্যান্য মাছও মেলে না। প্রতিবাদ করলে নেমে আসে নির্যাতন এবং আড়তে মাছ বিক্রিতে হয়রানি। পাশাপাশি, মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময়ে প্রকৃত জেলেরা সরকারি প্রণোদনা পান না। তাদের দাবি, প্রণোদনার তালিকা হালনাগাদ করা হোক।

গতকাল রোববার (২৬ অক্টোবর) মুহুরী প্রজেক্ট ও চর খন্দকার জেলেপাড়ায় সরেজমিন ঘুরে অন্তত ২০ জন জেলের কাছ থেকে এসব অভিযোগ মিলেছে।

জেলেরা জানান, ১০-১৫ বছর আগেও এক মণ থেকে দুই মণ ইলিশ নিয়ে প্রতিটি নৌকা পাড়ে ভিড়ত। গত ৫-৭ বছর গড়ে ৭-৮ কেজি ইলিশ নিয়ে জেলেপাড়ার ঘাটে ভিড়ছেন সোনাগাজীর জেলেরা। এছাড়াও একসময় সোনাগাজীর উপকূল থেকে ৩০ প্রজাতির বেশি মাছ পাওয়া গেলেও নানা প্রতিকূলতায় কমছে সামুদ্রিক মাছ। বর্তমানে ফেনী নদী ও মোহনায় ১২-১৫ প্রজাতির মাছ নিয়মিত পাওয়া যাচ্ছে। আবার কিছু প্রজাতি নিয়মিত না পাওয়া গেলেও হঠাৎ জালে উঠে আসে, তবে এর পরিমাণ খুবই অল্প।

চর খন্দকার জেলেপাড়ার জেলে সর্দার আফসার মহাজন বলেন, বড় ফেনী নদীর মোহনায় বরিশাল, রামগতি, হাতিয়া, চর আলেকজান্ডার এলাকার দেড় হাজারের অধিক জেলে নিষিদ্ধ কারেন্ট, বেহুতি জাল ব্যবহার করে মাছ ধরছে। তাদের কারেন্ট জালের বিস্তার এত বেশি আমরা জাল ফেলার জায়গা পর্যন্ত পাই না। এসব নিষিদ্ধ জাল ব্যবহারে জাটকাসহ রেণু ও পোনা মাছ ব্যাপকভাবে ধ্বংস হচ্ছে। এই কারণেই গত তিন বছর ধরে সোনাগাজীর জেলেরা ইলিশ পাচ্ছে না। যত দিন যাচ্ছে, উপকূল থেকে তত মাছ কমে যাচ্ছে। বহুবার এ অভিযোগগুলো করেছি কিন্তু ফল পাইনি অথচ মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময় কঠোরভাবে তা মানতে বাধ্য করা হয়।

তিনি আরও বলেন, প্রশাসন ও মৎস্য দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বারবার জানিয়েছি, আমরা সরকারি নির্দেশনা মেনে চলি কিন্তু অন্য জেলার জেলেরা নির্দেশনা না মেনে সারাবছর নিষিদ্ধ জাল ব্যাপক হারে মোহনায় ব্যবহার করছে। তারা নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও মোহনায় মাছ ধরে। এভাবে চলতে থাকলে সোনাগাজী অঞ্চলের জেলেরা পথে বসে যাবে।

জেলে সর্দার আফসার মহাজনের মতো একই কথা বলেন জেলে সর্দার সুধাংশু, জেলে সুদাম, প্রিয়নাথসহ একাধিক জেলে। মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞাকালীন সরকারের পক্ষ হতে প্রণোদনা দেওয়া হয়ে থাকে। এ নিয়েও অভিযোগ বিস্তর।

গত ১৫ বছর ধরে ইলিশ জাল দিয়ে মাছ ধরেন জেলেপাড়ার মো. শাকিল। তিনি প্রণোদনা পান না জানিয়ে অভিযোগ করে বলেন, ছোটবেলা থেকে আমি ইলিশ মাছ ধরতে সাগরের মোহনায় যাই। কিন্তু কখনো প্রণোদনা পাইনি। নিষেধাজ্ঞা সবসময় আমাদের ওপরই বলবৎ থাকে কিন্তু নিষেধাজ্ঞার সময়ে মোহনায় ইলিশ ধরে অন্য জেলার জেলেরা। কখনো দেখি না কর্মকর্তারা সেখানে গিয়ে অভিযান চালিয়েছেন। তারা আমাদের বলেন নিষেধাজ্ঞা মানলে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, বাস্তবতা হলো—আমরা মানলেও অন্য জেলার জেলেরা তা মানে না। ফলে আমরা আশানুরূপ মাছ পাই না, উল্টো ট্রলারের তেল খরচ পর্যন্ত উঠে আসে না। এই কারণে আমরা গলা সমান ঋণের জাল থেকে বের হতে পারছি না। সরকার যদি মোহনায় অভিযান না চালায়, তাহলে সামনে থেকে আর মাছ পাব না।

আরেক জেলে রাজু জলদাসের অভিযোগ, ফেনী নদীর মুখে জায়গা পাই না। বড় বড় নৌকা আসে, নিষিদ্ধ জাল ফেলে মাছ তুলে নেয়। আমাদের ছোট জাল ফেললে কিছুই ধরা পড়ে না। সরকারি আদেশ মেনে চলি, কিন্তু কখনো প্রণোদনা পাইনি। কর্মকর্তারা বললেন, প্রণোদনা পেতে নিবন্ধিত হতে হবে। এবার নিবন্ধিত হতে গেলে নগদ ৪২ টাকা এবং তিনটি স্ট্যাম্পে সাক্ষর নিতে হয়েছে। আমরা চাই, সরকার জেলেদের পাশে দাঁড়াক এবং অভিযোগ ও দাবিগুলো সমাধান করুক।

জেলে কিষাণ জলদাস বলেন, আমরা আইন মানতে রাজি কিন্তু প্রশাসন যদি অন্য জেলার অবৈধ জাল না সরায়, তাহলে আমরা কীভাবে বাঁচব?” কিষাণ আরও বলেন, “সরকারি প্রণোদনা ও বকনা বাছুর প্রকৃত জেলেরা পাচ্ছে না। আমাদের এখানে অনেকে রয়েছেন যারা প্রকৃত জেলে না হয়েও বাছুর পেয়েছেন।

এদিকে উপজেলা মৎস্য বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, সোনাগাজীতে নিবন্ধিত দুই হাজারের অধিক জেলে রয়েছেন। তাদের মধ্যে উপকূলীয় জেলের সংখ্যা এক হাজার। তন্মধ্যে কার্ডধারী ইলিশ জেলে রয়েছেন ২৭৫ জন। মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা সব জেলের জন্য প্রযোজ্য, তবে এই সময়ে শুধু নিবন্ধিত ইলিশ জেলেদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ৬ দশমিক ৮৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দের প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, শুধুমাত্র যেসব জেলে ইলিশ জাল ব্যবহার করেন তারা ছাড়া অন্যরা সরকারি সহায়তা পান না।

জেলেদের অভিযোগ, নিষেধাজ্ঞার সময় ইলিশ জেলেদের জন্য ২৫ কেজি চাল বরাদ্দ দিলেও সব জেলে এ চাল পান না। যেসব ইলিশ জেলে সহায়তা পান, তারাও দুই সপ্তাহের বেশি এ চাল দিয়ে সংসার চালাতে পারেন না। সরকার শুধু চাল দিলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য সব কিছু তো নিজেদেরই কিনতে হয়। ফলে অভিযানের সময় ঋণের বোঝা আরও ভারি হয় জেলেদের।

গতকাল সরেজমিনে মহুরী প্রজেক্ট ও চর খন্দকার জেলেপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, জেলেরা নিজ নিজ ট্রলারে জাল, খাবার, বরফ ও মাছ শিকারের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ গুছিয়ে নদীতে যাচ্ছেন। শনিবার রাত ১২টার পর ট্রলার ও জাল নিয়ে সাগরের মোহনায় মাছ ধরার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন প্রায় পাঁচ শতাধিক জেলে।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তাছলিমা আকতার বলেন, অভিযোগ আমরা পেয়েছি। নিয়মিত মোবাইল টিমের মাধ্যমে অভিযান চলছে। অন্য জেলার জেলেরা সোনাগাজীর সীমানায় নিষিদ্ধ জাল ফেললে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে আমরা অভিযানে গেলে তারা পালিয়ে যায়, একপ্রকার চোর-পুলিশ খেলার মতো হয়। এছাড়া আমাদের বরাদ্দ কম থাকায় সব জেলেকে প্রণোদনার আওতায় আনতে পারি না। এরপরও আমরা ওপরের দপ্তরে এই চাহিদার কথা বারবার বলে আসছি। প্রকৃত জেলে প্রণোদনা পাচ্ছেন না—এই অভিযোগ আমরা খতিয়ে দেখব। যদি এরকম কাউকে পাওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই বাদ দেওয়া হবে।

নিষেধাজ্ঞা চলাকালে অভিযান প্রসঙ্গে তিনি জানান, নিষেধাজ্ঞার সময়ে আমরা ২১ দিন অভিযান চালিয়েছি। এসময়ে ২ লাখ ৫০ হাজার মিটার জাল জব্দ করেছি, এরমধ্যে নিষিদ্ধ যেসব জাল ছিল সেগুলো পুড়িয়ে বিনষ্ট করা হয়।

মৎস্য কর্মকর্তা আরও বলেন, আমরাও চাই জেলেরা এই পেশার ওপর শতভাগ নির্ভরশীল না হয়ে পাশাপাশি জীবিকানির্বাহে অন্য পেশার সঙ্গে সংযুক্ত থাকুক। এজন্য আমরা তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও বকনা বাছুর বিতরণসহ নানা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।

জেলেদের অভিযোগ প্রসঙ্গে সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রিগ্যান চাকমা দৈনিক ফেনীকে বলেন, মোহনায় অন্য জেলার জেলেদের কারণে সোনাগাজীর জেলেদের অসুবিধার বিষয়ে কোন অভিযোগ পাইনি। বিষয়টি আমি জানতামও না। উপজেলা মৎস্য দপ্তরের সাথে কথা বলে জেলেদের অভিযোগ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।