জীবনের গল্প একেক অবস্থানে একেক রকম। তবে প্রতিটি জীবনের গল্পেই থাকে ‘সংগ্রাম’। এ সংগ্রাম নিরন্তর আমাদের বেঁচে থাকার। তেমনি একজন হচ্ছেন স্বামী পরিত্যক্তা নারী মরিয়ম বিবি। বয়স আনুমানিক ৪০-৪২ বছর। স্বামীর নাম আব্দুল কুদ্দুস। অনেক আগেই স্বামীর সংসার ছেড়ে এসেছেন। বর্তমানে ফেনী শহরের প্রাণ কেন্দ্র কলেজ রোডে পৌরসভার বিপরীতে রাস্তার ধারে চট আর ছালার বস্তাকে অবলম্বন করে আস্তানা গেড়েছেন তিনি। বয়সের ভারে তার মুখে জীবনের কঠিন সংগ্রামে ছাপ। তবু হাল ছাড়েন নি তিনি।


আন্তর্জাতিক নারী দিবসে দৈনিক ফেনীডটকমের রিপোর্টার মোস্তাফিজ মুরাদ মুখোমুখি হয়েছিল দুঃস্থ এ নারীর মুখোমুখি। পাঠকদের জন্য তুলে ধরতে তার জীবন সংগ্রামে ইতিকথা।
দৈনিক ফেনীডটকম- আপনার বাড়ি কি ফেনীতেই?


মরিয়ম বিবি- না আমার বাড়ি সিলেট, আগে আমি শাহজালাল মাজারের ওখানের একটি মাঠে থাকতাম। এখন এই দেশে (ফেনী) চলে এসেছি, এখানে স্থানীয় হয়ে গেছি।
দৈনিক ফেনীডটকম- আপনার স্বামী, বাবা-মা, ভাই-বোন কেউ আছেন?


মরিয়ম বিবি- আমার স্বামী আছেন। আমার ৮-৯ বছরে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। আর একজন বোন আছে। তার বিয়ে হয়েছে ব্রাহ্মনবাড়িয়াতে। তার একটা মেয়েও বিয়ে দিছে সে। ছেলে একটা আছে। আর মা-বাবা মারা গেছে অনেক আগে।


দৈনিক ফেনীডটকম- স্বামীর বাড়িতে থাকেন না কেন?


মরিয়ম বিবি- স্বামী সতিনের সাথে থাকে, তাই আমার সাথে থাকেন না, সে এখন পাগল। বড় সতীন তাকে পাগল করে ফেলেছে৷ আমাকে তার সাথে থাকতে দেয়না।


দৈনিক ফেনীডটকম- আপনার কোন সন্তান নেই?


মরিয়ম বিবি- না আমার কোন সন্তান হয়নি, আমি নিজেই সন্তান নেই নি। কিন্তু আমার সতীনের ঘরের দুইজন সন্তান আছে। মেয়ে একটাও বিয়ে দিছে।


দৈনিক ফেনীডটকম- আপনার বোনের সাথে আপনার যোগাযোগ নেই? তার বাড়িতে যান না?


মরিয়ম বিবি- নাহ, আগে যেতাম। এখন বোন ও আমাকে ভুলে গেছে। আমিও আর যাইনা।


দৈনিক ফেনীডটকম- স্বামী সংসার ছাড়া কিভাবে দিন কাটাচ্ছেন? আপনার কষ্ট হয়না?


মরিয়ম বিবি-(দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে) কষ্ট হইলেও কি করবো বাবাজি। কপালে আল্লাহ যা রাখছেন তাই হয়েছে। সবার কপালে সুখ থাকেনা। আমার নেই আর কি। কষ্ট পেতে পেতে আমি নিজেও এখন পাগল হয়ে গেছি, মাথায় জট হয়ে গিয়েছে৷ মাঝে মধ্যে ঠিক থাকি, আবার মাঝে মধ্যে পাগল হয়ে যাই।


দৈনিক ফেনীডটকম- আপনি এখানে থাকেন যে আপনার খাওয়া দাওয়ার ব্যাবস্থা কিভাবে হয়? টাকা পয়সার কিভাবে পান?


মরিয়ম বিবি- (হাত দিয়ে দেখিয়ে) ওই যে হোটেল (বারিক হোটেল) ওটাতে খাই। ওরা আমাকে খাবার দেয়। হোটেলগুলোতে গেলে তারা খাবার দেয়।

দৈনিক ফেনীডটকম- টাকার জন্য কি ভিক্ষা করেন? কেও টাকা পয়সা দিলে নেন?


মরিয়ম বিবি- নাহ আমি ভিক্ষা করিনা। নিজে যা পাই তা দিয়ে চলি৷ কেউ যদি নিজে আসি আমাকে দে তখন আমি নিই। তবে কেউ দেয়না। মাঝে মধ্যে এক দুইজনে ১০-২০ টাকা দেয়। পাবলিককে আমি কষ্ট দিনা, পাবলিক কষ্ট পেলে আমিও কষ্ট পাই। তাই কারো কাছে চাইনা, পাবলিক শান্তিতে থাকুক আমিও শান্তিতে থাকি।


দৈনিক ফেনীডটকম- বৃষ্টি হলে আপনার রাস্তার ধারে থাকতে কষ্ট হয়না? এখানে তো ভিজে যাবেন।


মরিয়ম বিবি- বৃষ্টি হলে ওই মার্কেটের ওখানে চলে যাই। কি করবো বাবাজি আল্লাহ আমার কপালে রাখছে।


দৈনিক ফেনীডটকম- আপনার এই দুঃখের জীবনে আপনার কষ্ট হয়না? আপনি কারো কাছে কোন সাহায্য চান?


মরিয়ম বিবি- আমার অনেক কষ্ট হয় বাবাজি। আমার মেলা কষ্ট, আমি সিলেটেও কষ্ট করেছি, এখানেও কষ্ট করতেছি। কষ্ট পেতে পেতে তো আমার মাথায় জট হয়ে গেছে৷ কতক্ষণ পর পর পাগলের মতো হয়ে যাই। আল্লাহ আমাকে যেভাবে রাখছে সেভাবে আছি৷ আমার কারো কাছে কোন চাওয়া নেই, সরকার যদি আমাকে কিছু দেয় আমি নিবো।


দৈনিক ফেনীডটকম- এই কষ্টের জীবনে আপনার তো টাকার দরকার হয়, টাকা কিভাবে পান? কোথাও কোন কাজ করেন?


মরিয়ম বিবি- না বাবাজি কাজ করতে পারিনা, মাথার মধ্যে জট তো। আমি পুরাতন বোতল বিক্রি করে টাকা যা পাই তা দিয়ে চলি।


দৈনিক ফেনীডটকম- মাথার মধ্যে কি ধরনের সমস্যা হয় আপনার? আপনি কোনদিন ডাক্তার দেখাইছিলেন?


মরিয়ম বিবি- আমার সে সামর্থ্য কি আছে বাবাজি যে ডাক্তার দেখাব। মাথার মধ্যে জট হয় গেছে। যখন জট হয়ে যায় তখন আমার মাথা ঠিক থাকেনা। তখন এভাবে কথা বলতে পারিনা, পাগলের মতো হয়ে যাই।


দৈনিক ফেনীডটকম- আপনি কি চান আপনার স্বামী আপনার কাছে ফিরে আসুক?


মরিয়ম বিবি- স্বামী ইচ্ছা হইলে আসবে না আসলে নাই। আমার আর কোন চাওয়া নাই। (হতাশ কন্ঠে)


দৈনিক ফেনীডটকম- স্বামীর বাড়িতে থাকা তো আপনার অধিকার, আপনার চাওয়া নাই কেন?


মরিয়ম বিবি- অধিকার দিয়ে কি করবো বাবাজি, আমার সতিন তো আমাকে জায়গা দেয়না। তাই আর কাউকে কিছু বলিওনা। আমি চেষ্টা করছিলাম থাকার, আমাকে বের করে দিছে। সে আমাকে দেখতে পারেনা। আমার জামাইরেও দেখতে পারেনা, আমারে একবার নিয়ে, গেছিল আমাকে বের করে দিছে আবার।


শতবাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে সংগ্রামী মরিয়ম বিবি চলছেন তার আপন শক্তিতে। কারো কাছ থেকে চান না, নিজে বোতল বিক্রি করে টাকা উপার্জন করেন৷ শারীরিক অসুস্থতার জন্য কাজ করতে পারেন না।


এমন হাজারো মরিয়ম রয়েছে আমাদের দেশের অলিতে-গলিতে, একদিন তারাও সুখের মুখ দেখবে সেটাই প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশা বিবি মরিয়মেরও।