ফেনীতে কোনভাবেই যেন থামছেনা কৃষি জমির টপ সয়েল কাটা। অভিযোগ রয়েছে, জেলার প্রতিটি উপজেলাতেই চলছে কৃষি জমির টপ সয়েল কেটে চলছে রমরমা বেচাকেনা। প্রশাসন বলছে, অভিযান চলছে অবিরত। বাস্তব চিত্র, দিনে অভিযান চললে মাটি ব্যবসায়ীরা বেছে নিচ্ছেন রাতের আঁধারকে।


অভিযোগ পাওয়া গেছে, ফেনীর ৬টি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে কৃষি টপ সয়েল কেটে ইটভাটায় বিক্রি করা হচ্ছে। এমন চিত্র জেলার বিভিন্ন উপজেলায় চোখে পড়ছে। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরিকল্পিত মাটি কাটায় পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে, ফসলি জমি হারাচ্ছে উর্বরতা শক্তি।


জেলা প্রশাসনের জেএম শাখা সূত্রে জানা যায়, সদরের পাঁচগাছিয়া, শর্শদী, লেমুয়া, ফরহাদগনর ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে মাটি কাটার অভিযোগে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। একই সূত্রে জানা যায়, দাগনভূঞা, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া, সোনাগাজী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মাটি কাটা বন্ধ করতে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমান আদালত অভিযান চালিয়েছে।


ফসলি জমির উপরিভাগের গুরুত্ব প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ফেনীর উপপরিচালক মোঃ মোশারফ হোসেন খান বলেন, কৃষিকাজের জন্য টপ সয়েল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি দীর্ঘদিন ধরে প্রাকৃতিকভাবে ও জৈব ব্যবস্থাপনার ফলে মাটির উপরের ৬-৭ ইঞ্চি জমির প্রাণশক্তিতে পরিণত হয়। এ টপ সয়েল সরিয়ে নিয়ে মাটির গুনাবলী নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে যে মাটি জমিতে থাকে তা ফসল ফলানোর জন্য উপযুক্ত থাকে না।


তিনি বলেন, টপ সয়েল কাটার ফলে জমির যে ক্ষতি হবে তা ৫০ বছরেরও পূরণ করা সম্ভব নয়। মাটিতে যে জৈব পদার্থ প্রয়োগ করা হয় বা প্রাকৃতিকভাবে যে জৈব পদার্থ যুক্ত হয় তা ধীরে ধীরে হয়। একবার তা কেটে নিলে জমির প্রাণশক্তি ফিরে পেতে দীর্ঘকাল প্রয়োজন হয়।


টপ সয়েল কাটার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে একই দপ্তরের কৃষি প্রকৌশলী আমজাদ হোসেন জানান, মাটি কাটার ফলে কৃষি জমির ফসল উৎপাদন ৬০ হতে ৭০ ভাগ কমে আসবে। জমিতে স্বাভাবিকভাবে যে ফসল পাওয়া যেত, তা পেতে হলে অতিরিক্ত পরিমাণ খরচ করতে হবে। তবে কোনভাবেই উৎপাদন হার একই হবে না এবং ফসলের গুনাবলী নষ্ট হবে। অতিরিক্ত পরিমাণ রাসায়ানিক সার ব্যবহারের ফলে কৃষি জমিতে বিপর্যয় ঘটবে।


কৃষি প্রকৌশলী বলেন, এমনও হতে পারে কোন কোন ফসল ওই জমিতে চাষই করা যাবে না। কারণ জমিতে শিকড় গজানোর জন্য যে পরিবেশ দরকার টপ সয়েল কাটার ফলে তা নষ্ট হয়ে যাবে। এতে করে জমির উর্বরতা শক্তি এবং পানি ধারণ ক্ষমতাও নষ্ট হয়ে যাবে।


জেলা প্রশাসনের জেএম শাখা সূত্রে জানা যায়, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় শুধুমাত্র মাটি কাটা নিয়েই ২০টির অধিক ভ্রাম্যমান আদালত অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এসব অভিযানে মাটি কাটার সরঞ্জাম, মাটি পরিবহনে ব্যবহৃত ট্রাক-পিকআপ জব্দকরাসহ আর্থিক দন্ড প্রদান করা হয়েছে।


ফসলি জমির টপ সয়েল কাটা বন্ধ করতে জেলা প্রশাসন প্রত্যেকটি উপজেলায় ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করলেও তা বন্ধ হচ্ছে না। ফেনী জেলা প্রশাসক মোঃ ওয়াহিদুজজামান বলেন, কৃষি জমির মাটি কাটার ব্যাপারে আমাদের কোন ছাড় নেই। মাটি কাটা বন্ধে ইটভাটার মালিকদের নিয়ে আমরা সভা করেছি। বিভিন্ন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সতর্ক করা হয়েছে। প্রত্যেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের এ ব্যাপারে বলা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন স্থানীয় সকল জনপ্রতিনিধিদের এসব বিষয়ে অবহিত করছেন।


তিনি বলেন, এছাড়া বিভিন্ন সভায় মাটির কাটার অপকারিতা সর্ম্পকে ভিডিও প্রদর্শন করা হয়েছে। প্রত্যেকটা উপজেলায় এ ব্যাপারে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। অভিযানে মাটির কাটার বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করেছি এবং অনেকেই আর মাটি কাটবে না বলে আমাদের অঙ্গীকারনামা দিয়েছে। লোকজনকে সচেতন করার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের অবহিত করেছি। আমাদের পক্ষ হতে এ ব্যাপারে কোন ছাড় নেই।


তিনি বলেন, ইটভাটার মালিকরা বলছে, মাটি ছাড়া আমরা ইটভাটা চালাবো কিভাবে। আমরা বলেছি কৃষি জমির মাটি ছাড়া অন্য অন্য মাটি সংগ্রহ করতে। জেলা প্রশাসক বলেন, এজন্য জনগণের সহযোগিতা লাগবে। তিনি বলেন, একটি সিন্ডিকেট এ কাজ করছে। তারপরও আমরা যথেষ্ট এ্যাকশনে যাচ্ছি। বাংলাদেশে একমাত্র জেলা হিসেবে আমরাই সর্বাধিক অভিযান চালাচ্ছি। তিনি বলেন, একটা ইটভাটায় ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানাসহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে পুলিশ সুপারের সাথেও আলাপ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক বলেন, সবার আগে ভূমি মালিককে সচেতন হতে হবে।


পরশুরামের বক্সমাহমুদ ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন চৌধুরী বলেন, মাটি কাটার ব্যাপারে প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করার পর, দিনের বদলে তারা রাতে দেদারসে মাটি কেটে নিচ্ছে। এ ব্যাপারে স্থানীয় লোকজন আমাকে অনেকবার অভিযোগ করছে। আমি বিষয়গুলো প্রশাসনকে অবহিত করেছি।


চেয়ারম্যান বলেন, মাটি পরিবহনে ব্যবহৃত ভারী যানবাহনগুলোর কারণে গ্রামীন সড়কগুলো বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি হলেই তা পিচ্ছিল হয়ে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যায়ে সড়কগুলো নির্মাণ করলেও এসব কারণে সেগুলোর করুণ দশায় উপনীত হয়েছে। দক্ষিণ গুথুমা থেকে বক্সমাহমুদগামী রাস্তা, তালতলা হতে খন্ডল হাই স্কুলের রাস্তার বেহাল দশা। এসব সড়কে মাটি পরিবহনে ব্যবহৃত ভারী গাড়ি চলছে। এতে করে সৃষ্ট ধুলোবালির কারণে রাস্তা দিয়ে স্কুলে যাতায়াতকারী শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।


মাটি বিক্রি করা এক ভূমি মালিকের সাথে কথা বলে জানা যায়, ব্যবসায়ীরা তাদের মাটি বেচার ব্যাপারে উৎসাহিত করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ভূমি মালিক জানান, মাটি ক্রেতারা বলছে টপ সয়েল কাটলে জমির কোন ক্ষতি হবে না। এক বছরের মধ্যেই বর্ষা এলে জমির সেই মাটি পূরণ হয়ে ফসল ফলানো যাবে।


মাটি কাটার ব্যাপারে জানতে কিছুদিন পূর্বে বক্সমাহমুদের কেবিএম ব্রিক ফিল্ডের মালিক মোশাররফকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, আমরা গাড়ি হিসেবে মাটি কিনি। সরাসরি কোন ভূমি মালিক হতে মাটি কিনি না। তিনি বলেন, প্রশাসনের অনুমতিক্রমে আমরা পুকুর হতে মাটি কাটছি।


ফেনী জেলা ট্রাক, কভার্ডভ্যান ও পিকআপ পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা জানান, জমির মালিক টাকার প্রয়োজনেই মাটি বিক্রি করছে। তারা নিজেরাই মাটি ব্যবসায়ীদের খবর দিচ্ছেন।