সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে নির্মমভাবে পুড়িয়ে হত্যা মামলার রায়ের এক বছর পূর্ণ হয়েছে আজ। ২০১৯ সালের (২৪ অক্টোবর) এ দিনে এ হত্যার ঘটনার ২০০ দিনের মাথায় ৬১ কার্যদিবস শুনানির পর প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলাসহ ১৬ জনের ফাঁসির রায় দেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোঃ মামুনুর রশিদ। এছাড়া প্রত্যেকের ১ লাখ টাকা জরিমানা করেন তিনি। এরপর ২৯ অক্টোবর ডেথ রেফারেন্সের জন্য নুসরাত হত্যা মামলার রায়সহ নথিপত্র হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এসে পৌঁছায়, যা ১৪০/১৯ নম্বর ডেথ রেফারেন্স হিসেবে নথিভুক্ত হয়।

সূত্রমতে, নুসরাত হত্যা মামলায় দন্ডিত সব আসামি আপিল করেছেন। তাঁদের মধ্যে সাবেক অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি উম্মে সুলতানা, নুর উদ্দিন ও জাবেদ হোসেন রয়েছেন। বর্তমানে চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলাটি হাইকোর্টের আপিল বিভাগে ডেথ রেফারেন্স শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।

মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিরা (ঘড়ির কাঁটার দিকে): অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা, নূর উদ্দিন, জোবায়ের, সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, আবছার উদ্দিন,
আব্দুর রহিম শরীফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, রুহুল আমীন, উম্মে সুলতানা ওরফে পপি, কামরুন নাহার মনি,
মাকসুদ আলম, হাফেজ আব্দুল কাদের, ইমরান হোসেন, মহিউদ্দিন শাকিল, মোহাম্মদ শামীম ও শাহাদাত হোসেন শামীম

নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শাহজান সাজু বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক প্রস্তুতের পর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন মামলাটি হাইকোর্টে শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করেছিলেন। বিচারিক আদালতের রায়ের চার মাসের মাথায় এ মামলা হাইকোর্টে শুনানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে মামলাটির কার্যক্রম দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে। পূজার ছুটি শেষ হলে মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানা যাবে।

তিনি বলেন, বিচারপতি হাসান ইমাম ও সৌমেন্দ্র সরকার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে এ মামলার শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। নুসরাতের পরিবার চায় দ্রুত সময়ের মধ্যে রায় কার্যকর করে সরকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক।

গেল বছরের দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও আলোড়ন তুলেছিলে হয়েছিল এ হত্যাকান্ডের ঘটনাটি। সারাদেশে তুলেছিল প্রতিবাদের ঝড়। নুসরাত হত্যার বিচার দাবিতে রাস্তার নেমে এসেছিল সমাজের সর্বস্তরের মানুষ।

আদালতে রায় শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সিরাজ-উদ-দৌলা

সোনাগাজী চরচান্দিয়া এলাকার নুসরাতের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নিরাপত্তার জন্য নুসরাতের বাড়িতে এখনও তিনজন পুলিশ সদস্য সার্বক্ষণিক পাহারায় রয়েছেন। রায় কার্যকর না হওয়ায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন নুসরাতের স্বজনরা। স্বাভাবিক হয়ে উঠেনি পরিবারের জীবনযাত্রা। উচ্চ আদালতের দিকে তাকিয়ে আছে নুসরাতের পরিবার।

রায়ের এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নুসরাত জাহান রাফির মা শীরিনা আক্তার বলেন, খুনিরা আমার বুকের মানিক রাফিকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। আজ দেড় বছর আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারি না। দুই চোখের পাতা বন্ধ করলে রাফির পোড়া শরীর আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে সবিনয় অনুরোধ জানাই, উচ্চ আদালতে মামলাটির কার্যক্রম দ্রুত শেষ করে খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হোক।

আরও পড়ুন ⇒ ‘আজ নুসরাত হত্যাকান্ডের এক বছর’

মামলার বাদী নুসরাত জাহান রাফির বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, আমরা আদালতের প্রতি শতভাগ আস্থাশীল। নিম্ন আদালতে আমরা ন্যায় বিচার পেয়েছি, আশা করছি উচ্চ আদালতেও আমরা ন্যায় বিচার পাব। তিনি বলেন, রায়ের এক বছর পরও সাজা কার্যকর না হওয়া অপ্রত্যাশিত। জরুরী ভিত্তিতে উচ্চ আদালতের আপিল শুনানী শেষে দ্রুত সাজা কার্যকরের দাবী জানান তিনি।

নুসরাত হত্যাকান্ডের সুষ্ঠ বিচারের আশ্বাস দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

গত বছরের ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে নুসরাতের শ্লীলতাহানি করেন। এ ঘটনায় ওইদিনই সোনাগাজী থানায় নুসরাতের মা শীরিনা আক্তারের থানায় অভিযোগ করেন। এর পরদিন অধ্যক্ষকে সিরাজ-উদ-দৌলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মামলা তুলে না নেওয়ায় কারাগারে বসেই এ হত্যাকান্ডের নকশা করে সিরাজ-উদ-দৌলা।

আরও পড়ুন ⇒ ‘ক্ষমার অযোগ্য সিরাজ’

এরপর ৬ এপ্রিল মাদ্রাসার প্রশাসনিক ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন বোরকা পরা দুর্বৃত্তরা। এতে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটিতে মারা যায় রাফি। এ ঘটনায় ৮ এপ্রিল নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান (নোমান) সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। পরে মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়।

আরও পড়ুন ⇒ ‘কারা প্রকোষ্ঠে নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ অধ্যক্ষ সিরাজ’

মামলাটির প্রয়োজনীয় তদন্ত শেষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশান (পিবিআই) ১৬ জন আসামীকে অভিযুক্ত করে চার্জশীট প্রদান করেন। ২০ জুন অভিযোগ গঠন করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। পরে ৬১ কার্য দিবসের মধ্যে ৮৭ জনের স্বাক্ষ্য গ্রহন শেষে ২৪ অক্টোবর রায় ঘোষণাকালে সকল আসামীর ফাঁসির দন্ডাদেশ দেন বিচারক মোঃ মামুনুর রশীদ। পাশাপাশি প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়।

এ মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ১৬ আসামি হলেন সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা, সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি রুহুল আমিন, সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম, মাদ্রাসার শিক্ষক হাফেজ আবদুল কাদের, প্রভাষক আফসার উদ্দিন, মাদ্রাসার ছাত্র নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ যোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, কামরুন নাহার মণি, উম্মে সুলতানা পপি ওরফে তুহিন, আবদুর রহিম শরিফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, মোহাম্মদ শামীম ও মহি উদ্দিন শাকিল। আসামিরা কারাগারে আছেন।

আরও পড়ুন ⇒ ‘নুসরাত হত্যা মামলায় ১৬ জনের মৃত্যুদন্ড’

অন্যদিকে নুসরাত জাহানের আপত্তিকর ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার অভিযোগে আইসিটি আইনে ব্যারিস্টার সৈয়দ সাইদুল হক সুমনের দায়ের করা মামলায় সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে আট বছরের কারাদন্ড প্রদান করে আদালত। একই সঙ্গে তাঁকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন এই রায় দেন। সাইবার অপরাধে এটিই ছিল প্রথম কোন মামলার রায়।

নুসরাত জাহান রাফি নৃশংস হত্যাকান্ডের দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও অমলিন রয়ে গেছে ফেনীর মানুষের মনে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে এখনও উচ্চারিত হয় নুসরাতের নাম। তাদের দাবি, উচ্চ আদালতে দ্রুত শুনানি শেষে রায় কার্যকর করা হোক। তাহলে নুসরাতের আত্মা শান্তি পাবে।