‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ’ বিপ্লবী কিশোর কবি সুকান্তের এই অনিন্দ্যসুন্দর পঙক্তির কাব্যসত্যকে অস্বীকার না করেও বলবো, বাংলাদেশ আর-যাই-হোক ‘হঠাৎ’ করে হয়নি। তার একটি বঙ্কিম ইতিহাস আছে ঐতিহাসিকভাবে এই প্রারম্ভটা অন্তত কয়েক হাজার বছরের। যখন থেকে এই গাঙেয় আববাহিকায় পলল ব-দ্বীপ, ফুল-ফসল, পশুপাখি ও মানববসতি পরিলক্ষিত হয়েছে তখন থেকে। ভাঙন ও মিলনের দ্বৈতলীলায় বাংলার মাটি, বাংলার ভূ-সীমা, বাঙালির নৃতত্ত্ব, দেহভঙ্গি, তার সংস্কৃতি ও সর্বোপরি তার ভাষা বিবর্তিত হতে হতে আজকের এই রুপ। রাজনৈতিকভাবে আজ এই পলল-বদ্বীপেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এক জাতিরাষ্ট্র, যার নাম বাংলাদেশ। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে ষড়যন্ত্রে পরাজিত হয়ে প্রায় দুইশ বছরের ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে তৎকালীন বাংলা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়। কিন্তু বাঙালিদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তারা বাঙালিদের স্বাধীনতা, ভাষা, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, সামাজিক অবস্থা ও রাজনীতির উপর আঘাত হানে। পাকিস্তানি শাসকেরা প্রথমে আঘাত হানে ভাষার উপর। এতে বাঙালি জাতির জাতীয়তাবাদের প্রকৃত উন্মেষ ঘটে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট একচ্ছত্রভাবে জয়লাভ করে মন্ত্রিসভা গঠন করলেও ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া হয়নি। ১৯৫৮ সালে পকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সামরিক শাসন জারি করেন এবং বাঙালির উপর শোষণ-নিপীড়ন শুরু করেন। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুথানের ফলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা গ্রহণের পর জনপ্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ জয়লাভ করলেও রাষ্ট্রক্ষমতা দেয়া হয়নি। এরই ফলশ্রুতিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৯৭১-এর ৭ মার্চ উত্তাল জনস্রোতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের ডাক দিয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন 'ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' তাঁর এ বক্তব্যে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে মুক্তি পাগল বাঙালি। পাকিস্তানিরা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানে 'অপারেশন সার্চ লাইট' নামে নারকিয় গণহত্যা চালায়। ২৫ মার্চ মধ্য রাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতারের পূর্বে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ২৭ মার্চ ১৯৭১ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র হতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন মেজর জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণায় বাংলার আপামর জনতা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বরের আগেই ৬ ডিসেম্বর ফেনী হানাদার মুক্ত হয়।

সময়ের ভেলায় চড়ে আবারও এলো ৬ ডিসেম্বর ফেনী মুক্ত দিবস। এটি ফেনীবাসীর জন্য গৌরব, অহঙ্কার, সবচেয়ে আনন্দ ও পরম প্রাপ্তির দিন। যেদিন বাংলার বীরমুক্তি সেনানীদের দীপ্ত পদভারে প্রকম্পিত হয়েছিলো ফেনীর আকাশ বাতাস। ৭১’র এই দিনে মুক্তিযোদ্ধারা সম্মুখ সমরে পাকবাহিনী পরাজিত করে ফেনীর পূর্বাঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করে ফেনীর মাটিতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিল। নভেম্বরের শেষ দিকে ফেনী জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধা আর মিত্রবাহিনীর প্রবল আক্রমণে দিশেহারা পাকবাহিনী আর তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আল শামস্ বাহিনীসহ মিলিশিয়া বাহিনী ফেনী জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পালিয়ে এসে ফেনী শহরে জড়ো হয়।

ফেনী অঞ্চলের মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক হিসাবে কর্মরত তৎকালীন ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে (পরবর্তীতে লেঃ কর্ণেল হিসেবে অবঃ) ভারতের বিলোনিয়া ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল থেকে ১০ ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অভিযান চালিয়ে বিলোনিয়া, পরশুরাম, মুন্সীরহাট, ফুলগাজী হয়ে যুদ্ধ করতে করতে এগোতে থাকলে পর্যুদস্ত হয়ে ফেনীর পাক হানাদার বাহিনীর একটি অংশ নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী হয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের রাস্তায় এবং অন্য অংশ শুভপুর ব্রিজের ওপর দিয়ে চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। অপরদিকে মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) ফেনী মহোকুমা কমান্ডার বর্তমান ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক জয়নাল আবদীনের (ভিপি জয়নাল) নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা দাগনভূঁইয়া, রাজাপুর, সিন্দুরপুর হয়ে শহরের দিকে এগোতে থাকে। ফেনী হানাদারমুক্ত হওয়ার কারণে ঢাকা-চট্টগ্রামের সাথে সড়ক ও রেল পথে হানাদার বাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ রূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এতে করে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সূর্য উদিত হওয়ার বিষয়টি সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে ফেনীর অনেকগুলো রণাঙ্গনের মধ্যে মুন্সীরহাটের মুক্তারবাড়ী ও বন্ধুয়ার প্রতিরোধের যুদ্ধ ইতিহাস খ্যাত হয়ে আছে। এ রণাঙ্গনে সম্মুখ সমরের যুদ্ধ কৌশল বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানী মিলিটারী একাডেমিগুলোতে পাঠসূচীর অংশ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। যা এ রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের অংহকার আর গর্বের বিষয়। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য ফেনীর ৩১জন মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় খেতাব দেওয়া হয়। খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ৪জন বীর উত্তম, ৭জন বীর বিক্রম ও ২০জন বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা ফেনী সরকারি কলেজ তৎকালীন সিও অফিসসহ কয়েককটি স্থানে স্বাধীনতাকামী নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছিল। স্বাধীনতার পর জেলার বিভিন্ন স্থানে আটটি বধ্যভূমিতে শহীদদের লাশ শনাক্ত করতে ছুটে বেড়িয়েছিল স্বজনরা। ফেনীর বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে ফেনী সরকারি কলেজ এলাকার বধ্যভূমি, দাগনভূঁইয়ার রাজাপুর স্কুল এন্ড কলেজ সংলগ্ন চৌধুরী বাড়ির পার্শ্বে অরক্ষিত বধ্যভূমি, ফুলগাজীর জামুড়া গ্রামের বধ্যভূমি, পরশুরামের মালিপাথর বধ্যভূমি ও একই উপজেলার সলিয়া বধ্যভূমি উল্লেখযোগ্য। পরিতাপের সাথে বলতে হচ্ছে স্বাধীনতার ৪৯বছর পরে-ও ফেনীতে চিহ্নিত হয়নি অধিকাংশ বধ্যভূমি। অমর শহীদদের স্মৃতির ভাস্কর হিসেবে শহরের জেল রোডের পাশে বীর শহীদদের নামের তালিকা সম্বলিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। এতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অংকিত করা হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই স্মৃতিস্তম্ভে বীর শহীদগণের নাম অস্পষ্ট! নামগুলো পড়া যায় না।

ফেনী মুক্ত দিবসে আমাদের প্রত্যাশা ফেনীর আটটি বধ্যভূমি যথাযথভাবে চিহ্নিত করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবে। শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে বীর শহীদদের নামগুলো স্পষ্টভাবে লেখার ব্যবস্থা করা হোক দ্রুত। মহান মুক্তিযুদ্ধে ফেনীর যে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে এ ইতিহাস স্মরণ করতে ও নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানাতে ৬ ডিসেম্বর ফেনী জেলায় সরকারিভাবে ছুটি ঘোষণার আহ্বান জানাচ্ছি। একই সাথে আহবান জানাচ্ছি যে তারিখে যে জেলা হানাদার মুক্ত হয়েছে ওই তারিখে সংশ্লিষ্ট জেলায়ও সরকারিভাবে ছুটি ঘোষণা করার।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক