বাবা কিংবা মাকে ভালোবাসার জন্য আদতে কোনো দিবস কিংবা ক্ষণের প্রয়োজন পড়েনা। উষর এ পৃথিবীর বুকে একমাত্র উর্বর স্থানটি হল পিতামাতার বুক। প্রত্যেক সন্তানের কাছেই বাবা-মা হলো তাদের পাওয়ার হাউজ। সন্তানরা মাকে যেভাবে জড়িয়ে ধরে তাদের মনের আকুতি কিংবা ভালোবাসার কথা জানান দিতে পারে বাবাকে হয়তো ওভাবে বলতে পারেনা।

আমরা যারা ৯০’র দশকের আছি আমাদের কাছে বাবা মানে রাশভারী এক কঠিন অবয়বের মানুষ। যিনি পরিবারের কঠোর শাসনকর্তা। তাই বাবাকে ভালোবাসার কথা আমাদের বলাই হয়ে ওঠেনা।

বাবা যে সন্তানের জন্য কত বড় বটবৃক্ষ তা বুঝতে পেরেছি সেদিন- যেদিন ক্যাডেট কলেজে ভর্তির প্রসফ্যাক্টাসে আমার রোজগেরে অভিভাবকের যায়গাটা শূণ্য ছিল। সেদিন ১১ বছরের ছোট্ট হৃদয়টিতে যে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছিল তা আজও বহমান।

বাবাহীন পৃথিবীটা যে কতটা কঠিন তা বুঝতে পেরেছি প্রতি পদে পদে। যে বয়সে আমাদেও হেসে-খেলে পড়াশুনায় জীবন কাটানোর কথা সে বয়সে ধরতে হয়েছিলো জীবন যুদ্ধের হাল। এই স্বার্থপর শহরটাতে টিকে থাকার জন্য যখন টিউশনটাকে বেঁচে নিতে হল তখন কত মানুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হয়েছে তা কেবল উপরওয়ালাই জানেন। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চোখের জল ফেলতে ফেলতে ভাবতাম আজ যেখানে বাবা থাকলে একটা ফুলের টোকা দিতে সবাই ভয় পেতো সেখানে আজ কত মানুষ কত অমানবিক আচরণ করছে।

উচ্চ মাধ্যমিকের আগে তিনটে সর্বোচ্চ ফলাফল অর্জন করা মেয়েটাও যখন মেডিকেল কিংবা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির ফর্ম কেনার সুযোগটিও পায়না তখন মনে হয় বাবাহীন সন্তানদের এ পৃথিবীতে স্বপ্ন দেখার অধিকার নেই। কোনো রকমে বেঁচে থাকাই যেখানে দায়, সেখানে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখা বেমানান!

শুধু তাই নয়-অন্য কারো করুণা না নিয়ে নিজের পরিবারকে টেনে নিয়ে যাওয়ার পরও শুনতে হয় আত্মীয়স্বজনদের নাক কুঁচকানো কথা, প্রশ্নবিদ্ধ চাহনী। বাসা ভাড়া নিতে গেলে শুনতে হয় বাবা নেই সংসার কে চালাবে? মাস গেলে ভাড়া দিতে পারবেতো?

বাবা নেই বলে বিয়ের জন্য আসতে ভয় পেত মানুষ, পাছে পুরো সংসার ঘাড়ে গিয়ে পড়ে। মানুষের জন্য ইদ আসতো খুশির বন্যা নিয়ে, আর আমাদের জন্য ইদ মানে ফাঁস। একেবারে হতদরিদ্র রিক্সাচালক বাবাও তার সন্তানদের জন্য সাধ্যমত নতুন কিছু কিনে আনেন।

কতদিন আনমনে রাস্তায় রাস্তায় চোখের জল ফেলতে ফেলতে হেঁটেছি আর ভেবেছি পৃথিবীতে আর কিছু না থাকতো তাও বাবাটা যদি থাকত তাহলে হয়তো আমাদের জীবনটা অন্যরকম হতে পারত।

ভোর ৬টা, চারপাশ কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার। যে সময়টাতে আমার সমবয়সী বন্ধু-বান্ধবরা কাঁথা মুড়িয়ে ঘুমাতো সে সময়টাতে পেটের দায়ে পড়াতে যেতে হত। আমাকে দেখে ছাত্রীর বাবা যখন পরম আদওে মেয়েকে নিজে চা খাইয়ে ঘুম ভাঙিয়ে আমার সামনে পাঠাতেন তখন ভেতরটা দুমড়ে উঠতো এ ভেবে- আমিওতো কারো আদরের তনয়া ছিলাম। তিনি থাকলে আমায় কি আর আজ এখানে থাকতে হত?

এরকম হাজারো স্মৃতি আছে আমাদের বাবাহীন পথচলার। যে জীবনের প্রতিটা পরতে পরতে আমরা উপলব্ধি করেছি হাজার মানুষ না থেকে শুধু একজন বাবা সন্তানের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ।

আজও যখন আমি আমার ছেলে তার বাবাকে দেখলে প্রফুল হয়ে উঠতে দেখি, আনন্দে চোখে জল আসে। আর ভাবতে থাকি আমারও তো আব্বুকে দেখলে এমন প্রফুল্লতা কাজ করতো। ছেলেকে কাঁদতে দেখলে তার বাবা যেভাবে আগলে ধরে আর ছেলেটা যখন বাবার বুকে লেফটে থাকে, খুব ইচ্ছে করে একটাবার যদি বাবার বুকে মাথা রেখে দুফোঁটা চোখের জল ফেলতে পারতাম হয়তো অস্থির হৃদয় প্রশান্ত হত। আর মনে মনে এই প্রার্থনা করি, হে প্রভু আর কিছু না রেখো পৃথিবীর সকল সন্তানের জন্য তার বাবাকে রেখো।

লেখিকা :
সহকারী শিক্ষক
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়