ফেনীর ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ ফেনী সরকারি কলেজ ৯৯ বছর পেরিয়ে শতবর্ষে পদার্পণ করেছে। ১৯২২ সালের ৮ আগস্ট থেকে যাত্রা শুরু করে তৎকালীন সময়ের দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার অন্যতম প্রাচীন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যা আগামী বছরে শতবর্ষ পুরণ করবে। শত বছরে দেশের অন্যতম প্রাচীন এই বিদ্যাপীঠের রয়েছে গৌরবের অনেক ইতিহাস।

এই কলেজ থেকে পড়ুয়া অনেক গুণীজন দেশের শীর্ষ স্থানে রয়েছেন। অনেক শিক্ষক এই কলেজ থেকে নিজে পড়ছেন আবার পড়িয়েছেন কেও কেও এখনও পড়াচ্ছেন। সেই সাথে ভাষা আন্দোলন সহ মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের এই কলেজের ছাত্রদের ছিল অগ্রণী ভূমিকা।

দিনে দিনে এই কলেজের শিক্ষার মান উন্নয়নের পাশাপাশি অবকাঠামোগত ও সৌন্দর্য বর্ধনের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে।তবে ছাত্রছাত্রীরা কলেজের নিজস্ব একটি খেলার মাঠের দাবী জানিয়ে আসছে বহুবছর ধরে কিন্তু এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। জেলার শ্রেষ্ঠ কলেজ হওয়ার পাশাপাশি বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের ছাত্রছত্রীদের প্রথম পছন্দের কলেজ এটি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজগুলোর মধ্য চট্টগ্রাম বিভাগে কয়েকবার ২য় সেরা কলেজ নির্বাচিত হয়েছে ফেনী সরকারি কলেজ।

শতবর্ষে পদার্পণ করায় কলেজের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী, শিক্ষক,কর্মকর্তা, কর্মচারীরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় কলেজকে নিয়ে নিজের আবেগ ভালোবাসার ও স্মৃতিময় কথা তুলে ধরছেন অনেকেই। শতবর্ষপূর্তি উদযাপন করার প্রস্তুতি শুরু করার কথা থাকলেও করোনার কারণে তা সম্ভব হয়নি।

শতবর্ষে পদার্পণ করায় সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ফেনী সরকারি কলেজ এর অধ্যক্ষ প্রফেসর বিমল কান্তি পাল। দৈনিক ফেনীকে তিনি বলেন, এই কলেজের শিক্ষক শিক্ষার্থী সবাই এই কলেজ কে নিয়ে ভাবেন। কলেজের সাফল্যের জন্য সবাই একসাথে কাজ করছেন। এই কলেজের অনেক শিক্ষক রয়েছেন যারা এই কলেজে পড়েছেন এখন পড়াচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের বিভিন্ন আন্দোলনের সাথে এই কলেজের নাম জড়িত।

তিনি বলেন, বর্তমানে যেসব শিক্ষার্থী অধ্যায়নরত আছে তাদের জন্য এটি সৌভাগ্যর। তারা শতবর্ষের অংশীদার হতে পেরেছে। তারা উত্তরাধিকার সুত্রে এই কলেজ থেকে পড়ে দেশে উচ্চতর পর্যায়ে আসীন হয়ে দেশের নাম উজ্জ্বল করবে। এসময় তিনি শতবর্ষে পদার্পণ উপলক্ষ্যে সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শুভাকাক্সক্ষীদের কলেজের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানান।

শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষ্যে অধ্যক্ষ জানান, মহামারী করোনা ভাইরাস এর কারণে প্রস্তুতি নেয়ার কথা থাকলেও নেয়া সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে শিক্ষক শিক্ষার্থী ও সাবেক ও কলেজের অভিভাবকদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানান তিনি।

ফেনী সরকারি কলেজ উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক আহমেদ আলী বিভোর বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফেনী সরকারি কলেজের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। শতবর্ষী কলেজ হিসাবে ভবিষ্যতে 'সেন্টার অফ এক্সিলেন্স' হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে এই প্রত্যাশা আমাদের সকলের।

ফেনী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদ এর ভিপি তোফায়ের আহম্মেদ তপু বলেন, এ অঞ্চলে শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ আমাদের সরকারি কলেজ। এই কলেজের শিক্ষার্থী হিসেবে আমি গর্ববোধ করি।

শতবর্ষ উদযাপন সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের সবার আবেগের উচ্চ স্থানে অসীন ফেনী কলেজ। এই কলেজের শতবর্ষপূর্তি উৎসব উদযাপন করতে আমরা ফেনী সরকারী কলেজ শতবর্ষপূর্তি উৎসব নামে একটি গ্রুপ খুলেছি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল এই গ্রুপের মাধ্যমে কলেজের প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের সাথে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করে সুন্দর একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা।

তিনি বলেন, এ লক্ষ্যে আমরা গত বছর কার্যক্রম শুরু করার উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য আমাদের অভিভাবক ফেনী- ২ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী এমপি মহোদয়ের সাথে কথা বললে তিনি করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতার সার্বিক দিক বিবেচনা করে ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সকল অনুষ্ঠান পালনে বিধিনিষেধ থাকায় করোনা পরিস্থিতি উন্নতি হলেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দেন। কিন্তু গত একবছরেও করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় আমরা সেই উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়নি। করোনা পরিস্থিতি উন্নতি হলে আমরা উদ্যোগ গ্রহণ করবো।

শতবর্ষে পদার্পণ করায় কলেজ এর সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা অভিনন্দন জানাচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কলেজের ১৯৬৬-৭০ সালের সাবেক ছাত্র ও বর্তমানে প্রথম আলোর ফেনী প্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক আবু তাহের তার ফেসবুকে লিখেন, মহামারী করোনার কারনে নীরবে শতবর্ষে কলেজটি পদার্পণ করে ফেলেছে। তিনি লিখেন দেশের নানা ইতিহাস ও ঐতিহ্যর স্মারক ফেনী সরকারি কলেজ।

ফেনী সরকারি কলেজ ৯৫ ব্যাচের একজন সাবেক শিক্ষার্থী আবুল কাশেম বলেন, কলেজ জীবনের স্মৃতি ছিল অসাধারণ। ফেনী সরকারি কলেজ শতবর্ষ উদযাপন কেন্দ্র করে ২০১৫ সালে আমরা এইচএসসি ৯৫ ও ডিগ্রি ৯৭ ব্যাচের বন্ধুরা মিলে একটি কমিটি করেছি৷ যেটির মাধ্যমে আমরা এখনও সবাই ঐক্যবদ্ধ আছি। তিনি বলেন, কলেজ এর শতবর্ষ উদযাপন ঝাঁকজমকভাবে করার ইচ্ছা আছে। করোনা মহামারী কেটে গেলে বর্তমান আর সাবেকরা মিলে শতবর্ষ উদযাপন এর প্রস্তুতি নিব।

তৌহিদুল ইসলাম তুহিন নামে কলেজ এর সাবেক একজন শিক্ষার্থী বলেন, শতবর্ষে আমাদের ফেনী সরকারি কলেজ। দক্ষিন বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী কলেজে পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার এটাই আমার জন্য গর্বের। কলেজে কাটানো স্মৃতিগুলো খুবই সুন্দর ছিল।

শাহনেওয়াজ চৌধুরী ইলা নামে কলেজের বর্তমান একজন শিক্ষার্থী বলেন, ফেনী সরকারি কলেজে পড়তে পারা আমাদের জন্য গর্বের। আমরা অত্র অঞ্চলের সেরা কলেজে অধ্যায়নরত থাকা অবস্থায় কলেজ শতবর্ষে পা দিয়েছে এটি আমাদের জন্য সৌভাগ্যর। এসময় তিনি কলেজ জীবনের বিভিন্ন স্মৃতি কথা উল্লেখ করেন।

১৯২২ সালে ফেনী কলেজ যখন যাত্রা শুরু করে তখন বাংলা, ইংরেজি, আরবি, ফারসি, সংস্কৃত, গণিত, ইতিহাস ও যুক্তিবিদ্যা বিষয়ে ১৪৬জন শিক্ষার্থী নিয়ে আই.এ ক্লাস চালু করা হয়। বর্তমানে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে উচ্চ মাধ্যমিক শাখা ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৫টি বিভাগে স্নাতক-স্নাতকোত্তর (সম্মান), ৪টি বিষয়ে স্নাতক(পাস) কোর্স সর্বমোট ২৪ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত আছে।

উল্লেখ্য, ১৯১৮ সালের দিকে কলেজটি প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও ১৯২২ সালে তৎকালীন সময়ে খান বাহাদুর বজলুল হক একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করেন এবং তখন থেকেই মূলত কলেজটির যাত্রা শুরু হয়। ফেনী সরকারি কলেজটি যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন বৃহত্তর নোয়াখালীতে এটিই ছিল উচ্চশিক্ষার একমাত্র প্রতিষ্ঠান। ২য় বিশ্ব যুদ্ধ সহ দেশের বিভিন্ন ইতিহাসের সাথে এই কলেজের নাম জড়িত।