আইনের তোয়াক্কা না করে বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রণীত সিলেবাসে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সহায়ক বই। প্রধান শিক্ষক সিলেবাসগুলো প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও শিক্ষার্থীরা বলছে একই সিলেবাসেই পাঠদান চলছে। বিষয়টিকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন আইনের প্রতি অবজ্ঞা এবং সুনির্দিষ্টভাবে লঙ্ঘন।

---------------------------------
কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি সহায়ক বই বাধ্যতামূলক করে থাকে তা নিশ্চিতভাবে আইনের লঙ্ঘন এবং এটি একটি অপরাধ। পাশাপাশি এটি এনসিটিবির সাথে ধৃষ্টতা’
- অধ্যাপক মোঃ মশিউজ্জামান
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, এনসিটিবি
---------------------------------
‘কোনো ধরনের নোট বা গাইড তালিকাভুক্ত করা, কিনতে বাধ্য করাও আমাদের বিধি পরিপন্থী। এ ধরনের কাজ শুধুমাত্র স্বল্প মেধা বা জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরাই এমন করতে পারে’
-কাজি সলিম উল্লাহ
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ পরিকল্পনা (সিলেবাস) প্রণয়নে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রণীত বই অনুকরণের নির্দেশনা রয়েছে। শিক্ষা ব্যায় কমাতে সরকার প্রতিবছর বিনামূল্যে বই বিতরণ করছে। কিন্তু ফেনী সেন্ট্রাল হাইস্কুল যেন এর ব্যতিক্রম। শিক্ষার্থীরা স্কুল হতে ২০ টাকা মূল্যে যে সিলেবাস বই কিনছে তাতে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সহায়ক বই। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের বক্তব্য এবং বইয়ের দাম অনুযায়ী প্রায় ৩ হাজার শিক্ষার্থীকে শুধুমাত্র বাংলা ও ইংরেজির জন্য খরচ করতে হচ্ছে আনুমানিক সাড়ে ২৭ লাখ টাকা।

সিলেবাস বই পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৬ষ্ঠ হতে ৯ম পর্যন্ত প্রতি শ্রেণিতে বাংলা ও ইংরেজি দুইটি করে মোট ৮টি সহায়ক বই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, পাঠ পরিকল্পনায় পাঠ্যসূচির পরিবর্তে নির্দিষ্ট দুইটি বইয়ের পৃষ্ঠা নম্বর এবং সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থীকে স্কুলের সাময়িক পরীক্ষাগুলোতে পাশ করতে হলে অবশ্যই বইগুলো কিনতে হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যালয়ের দুইজন শিক্ষক জানান, সিলেবাস বইগুলো তৈরি এবং বইগুলো বাধ্যতামূলক পাঠ্য করার জন্য প্রধান শিক্ষক মোঃ সাইফুল ইসলাম গ্রহণ করেছেন মোটা অংকের অর্থ। বইগুলোর প্রকাশনী কর্তৃক বিনামূল্যের সিলেবাস বই শিক্ষার্থীরা কিনেছে ২০ টাকা করে। তবে সাইফুল ইসলাম সিলেবাসে সহায়ক বই বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি জানতেন না বলে দাবি করেছেন। স্কুলের একজন শিক্ষককে এজন্য দায়ী করে তাকে শনাক্ত করা হবে বলে জানান।

সিলেবাসে সহায়ক বই বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি অনিয়ম স্বীকার করে নিয়ে প্রধান শিক্ষক বলেন, ইতোমধ্যে সিলেবাসগুলো প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছি।

তবে প্রধান শিক্ষকের এ বক্তব্যের বিপরীতে বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী জানান, এ ধরনের কোনো নোটিশ ক্লাসে দেয়া হয়নি। নিয়মিত ক্লাসে সিলেবাসের পাঠ্যসূচি অনুযায়ী এখনও শিক্ষকরা পাঠদান করছে।
উল্লেখ্য, চলতি শিক্ষাবর্ষে ফেনী সেন্ট্রাই হাই স্কুলের সিলেবাসের প্রচ্ছদে প্রতিষ্ঠাকাল ১৯১৯ সালের পরিবর্তে ১৯৯৯ সাল ছাপানো হয়েছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠে। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের অনেকে শতবর্ষী স্কুলের প্রতিষ্ঠাকাল ভুল ছাপানোকে তথ্য বিকৃতি বলে দাবি করেন। এর প্রেক্ষিতে স্কুলের প্রধান শিক্ষক সিলেবাসের প্রচ্ছদ প্রত্যাহারের ইতোপূর্বে ঘোষণা দেন। কিন্তু সিলেবাসের ভেতরে পাঠ্যসূচি এবং সহায়ক বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে কোন মন্তব্য করেন নি।

সহায়ক বই বাধ্যতামূলক করা প্রসঙ্গে স্কুল পরিচালনা কমিটির সদস্য সাবেক পৌর কাউন্সিলর মোশারফ হোসেন জানান, এ ধরনের কোন বই বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি পরিচালনা পর্ষদের সভায় উত্থাপিত হয়নি এবং এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নি।

বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও পৌর কাউন্সিলর আশ্রাফুল আলম গীটার জানান, সিলেবাস বইয়ে সহায়ক বইয়ের নাম উল্লেখ করা কোনভাবেই ঠিক হয় নি। আমি পবিত্র ওমরাহ পালনের জন্য দেশের বাইরে ছিলাম। এ বিষয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বিবি আয়েশা নামে নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানান, শিক্ষকের পরামর্শে সিলেবাস অনুযায়ী পড়ার জন্য দুটো গাইড বই কেনা হয়েছে।
মোহাম্মদ ইব্রাহিম নামে অপর একজন অভিভাবক জানান, পাঠ্যক্রমে সহায়ক দুটি বই কেনার জন্য বলা হয়েছে, যার দাম ৭৫০ টাকা।
আনোয়ার হোসেন নামে এক শিক্ষার্থীর বাবা জানান, ফেনীর অন্যান্য হাইস্কুলে ৫-৬ বিষয়ে প্রতিদিন ক্লাস হলেও ফেনী সেন্ট্রাল হাই স্কুলে মাত্র ২-৩ বিষয় পড়ানো হয়। এতে করে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে সন্তানরা।
উল্লেখ্য বিদ্যালয়ে বর্তমানে ৩ হাজার ৭১৬ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।



‘এটি নিশ্চিতভাবে আইনের লঙ্ঘন’
 -এনসিটিবি চেয়ারম্যান
পাঠ্যসূচিতে সহায়ক বই বাধ্যতামূলক করাকে সরকারি নিয়মের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শণ মনে করছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকরা। এ প্রসঙ্গে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোঃ মশিউজ্জামান বলেন, এনসিটিবি আইনে পরিষ্কার নিষেধাজ্ঞা আছে আমাদের প্রণীত বই ছাড়া অন্য কোন বই পাঠ্য করা যাবে না। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি সহায়ক বই বাধ্যতামূলক করে থাকে তা নিশ্চিতভাবে আইনের লঙ্ঘন এবং এটি একটি অপরাধ। পাশাপাশি এটি এনসিটিবির সাথে ধৃষ্টতা।


‘স্বল্প জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরাই
এমন করতে পারে’
-জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা
এ প্রসঙ্গে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কাজি সলিম উল্লাহ দৈনিক ফেনীকে জানান, সরকার পাঠ্যপুস্তক নির্ভরতা বাড়াতে প্রতিবছর বিনামূল্যে বই বিতরণ করছে। সেখানে নির্দিষ্ট বই থেকে পাঠ্যসূচি দিয়ে সিলেবাস তৈরি করার কোনো সুযোগ নেই।কোনো ধরনের নোট বা গাইড তালিকাভুক্ত করা, কিনতে বাধ্য করাও আমাদের বিধি পরিপন্থী। এ ধরনের কাজ শুধুমাত্র স্বল্প মেধা বা জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরাই এমন করতে পারে।
এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে জানিয়ে শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আগে জানতাম না। তবে সিলেবাসের কোনো কপি বা অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে আমার অবস্থান থেকে একদম ছাড় দেয়া হবে না।


অভিযোগ একটি নয়, অনেক

করোনাকালীন সময়ের শুরু থেকে বিদ্যালয়ের কর্মকান্ডে সন্তুষ্ট নন অভিভাবকরা। একাধিক অভিভাবক অভিযোগ করেন, করোনাকালেও বিদ্যালয়ের নিয়মিত বেতন পরিশোধ করতে হয়েছে। এছাড়াও উন্নয়ন ফি, সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে এসাইনমেন্ট ফি, নিয়মিত পরীক্ষার ফি আদায় করা হয়েছে। অভিভাবকরা জানান, স্কুলের শিক্ষার্থীদের একটি অংশ নি¤œবিত্ত পরিবারের সন্তান। সেইসব পরিবারের পক্ষে বাড়তি ব্যায় বহন করা কষ্টসাধ্য।
নিজেদের দুদর্শার কথা উল্লেখ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক বলেন, শহরের ভিন্ন দুইটি প্রতিষ্ঠানে আমার দুই সন্তান পড়ছে। কখনও নির্দিষ্ট বই নির্ধারণের বিষয় চোখে পড়েনি। তবে এবার ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে সেন্ট্রাল হাই স্কুলে মেয়েকে ভর্তি করিয়ে বিপাকে পড়েছি। বছরের শুরুতেই গাইড বইগুলো কিনতে হচ্ছে। বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় পড়ালেখার খরচ যোগাতে এমনিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সেখানে বাড়তি টাকা খরচ করে সহায়ক বই কেনা আমাদের মতো মধ্যবিত্তের জন্য খুবই কষ্টকর। কারণ সহায়ক বই বাজারে পুরনোও কিনতে পাওয়া যায়।