গুলিবিদ্ধ হলেও তখনও প্রাণে বেঁচেছিল দাগনভূঞার তরুণ সরওয়ার জাহান মাসুদ। কিন্ত ‘রাজাকার’ সম্বোধন করে তাকে হাসপাতালে নিতে বাধা দিয়েছিল আওয়ামী দলীয় লোকজন। গত ৪ আগস্ট মহিপালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সংঘটিত নির্মম গণহত্যায় প্রাণ হারানো পরোপকারী এ তরুণ আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয়। শহিদদের নিয়ে দৈনিক ফেনীর ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ তৃতীয় পর্বে পড়ুন শহিদ মাসুদের দুঃসাহসী ভূমিকার কথা
৪ আগস্ট মহিপালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গুলিতে নিহত হন ফেনী কলেজ শিক্ষার্থী সরওয়ার জাহান মাসুদ (২১)। সে দাগনভূঞা উপজেলার উত্তর জয়লস্কর ইউনিয়নের মীর বাড়ির প্রবাসী শাহজাহান টিপুর ছেলে। মহিপালে আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে প্রাণ বাঁচাতে হাসপাতাল নিতে চাইলে বাধা দেয় আওয়ামী লীগ দলীয় লোকজন। তাদের পথ আটকে মাতুভূঞা ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল্লা আল মামুন তার ছোট ভাইকে বলেন, ‘সে তো রাজাকার। রাজাকার মরলে কিছু হয় না’।
গত ৪ আগস্ট মহিপালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বুকে ২টি এবং হাতে একটি গুলি লেগে ঝাঁজরা হয়ে যায় মাসুদের শরীর। মহিপাল সার্কিট হাউজ রোডে পড়ে থাকে তার নিথর দেহ। তবে তখনও প্রাণে বেঁচেছিল মাসুদ। অজ্ঞান অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে তার ছোট ভাই মাসুম আল সামীর।
‘আমার ভাই বেঁচে ছিল, সময়মত হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে সে প্রাণে বেঁচে যেত। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পথে গাড়ি থামিয়ে আমাদের বাধা দিয়েছিল। সে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মাতুভূঞা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল্লা আল মামুন ছিল। মাসুদকে তিনি বলেছিলেন, ‘সে তো রাজাকার। রাজাকার মরলে কিছু হয় না’।
সামীর বলেন, সেদিন ভাইয়া আমার আগে আন্দোলনে অংশ নিতে মহিপালে যায়। আমি পরে গিয়ে তার সাথে দেখা করি। আমি মহিপাল ফ্লাইওভারের উপরে উঠি, ভাইয়া নিচে ছিল। ওইদিন দুপুরের দিকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অতর্কিত চারদিক ঘেরাও করে গুলি করতে থাকে। ভাইয়ার বুকে দুইটি ও হাতে একটি গুলি লাগে। গুলির আওয়াজ শুনে ভাইয়াকে ফোন দিচ্ছিলাম। কেউ ধরছিল না। পরে সেখানে থাকা একজন লোক ফোন ধরে বললেন ভাইয়া গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পড়ে আছেন।
ঘটনার নির্মমতার কথা উল্লেখ করে সামির বলেন, শুনে তাৎক্ষণিক আমি এবং আরও কয়েকজন মিলে উদ্ধার করে দাগনভূঞা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। কিন্তু পথিমধ্যে দাগনভূঞার বেকের বাজার এলাকায় মাতুভূঞা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আবদুল্লা আল মামুন ও যুবলীগ-ছাত্রলীগের কর্মীরা গাড়ি থামিয়ে দেয়। এ খবর বাড়িতে জানানোর পর আত্মীয়-স্বজনরা এলে তাদেরও মারধর করা হয়। আমি অনেক অনুরোধ করার পর তাকে দাগনভূঞা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাই। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
কান্নাজড়িত কন্ঠে সামির আরও বলেন, মৃত ঘোষণার পর লাশ সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখান থেকে দ্রুত বাড়িতে নিতে চাইলেও বাড়ি নিতে বাধা দেওয়া হয়। আমাকে পাকিস্তান বাজার এলাকায় আবারও মারধর করা হয়। পরে রাত ১টায় ভাইয়ার লাশ বুঝে পেলে রাতের মধ্যেই লাশ দাফনের নির্দেশ দেওয়া হয়।
সামির অভিযোগ করে বলেন, আন্দোলনের শুরু থেকেই ভাইয়া সক্রিয় ছিলেন। ফেসবুকে লিখতেন এ সরকারের পতন খুব নিকটে। আমাকেও সাহস দিতেন। আব্বু আমাদের নিষেধ করলেও দুইভাই মিলে বের হয়ে যেতাম। সেদিন সকালে আম্মুর সাথে পারিবারিক একটা বিষয়ে ভাইয়ার কথা হয়। পরে আব্বুর অজান্তে আন্দোলনে অংশ নিতে চলে যায়। ভাইয়াকে শুরু থেকেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মারধর করবে বলে হুমকি দিত। আলী হায়দার নামে এনায়েতপুরের এক ছাত্রলীগ কর্মী ভাইয়াকে মারধর করলেও তাকে আসামী করা হয়নি কারণ তার ভাইও অন্য একটি রাজনৈতিক দলের নেতা।
মাসুদের ফুফাত ভাই মো. মোশারফ হোসেন জানান, গুলিবিদ্ধ মাসুদকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে আওয়ামী লীগের লোকজন বাধা দেয়। প্রত্যেকের মোবাইলে ফেসবুক প্রোফাইল লাল কিনা চেক করে দেখেছিল।
ছেলে হারানোর বেদনা ভুলতে পারছেন না মাসুদের মা বিবি কুলসুম। ছেলের শোকে এখনও আহাজারি করছেন তিনি। বিবি কুলসুম বলেন, আমার ছেলে মানুষের জন্য কাজ করতো। সামাজিক কাজে যুক্ত থেকে মানুষের উপকারে ব্যস্ত থাকত। তারা আমার ছেলেকে মেরে ফেলল। বাবার সাথে প্রবাসে যাওয়ার কথা ছিল তার কিন্তু তার আগেই সে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল।
তিনি বলেন, আমার বুকে ধনকে তারা মেরে ফেলেছে। সে কারও ক্ষতি করেনি। পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকত, নিয়মিত তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ত, রমজান মাসে ২০ রোজার পর মসজিদে এতেকাফ করতো। ছেলের হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেন তিনি।
এ ঘটনায় মাসুদের মা বিবি কুলসুম বাদী হয়ে ফেনী-২ সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীকে প্রধান আসামি করে ১৩৪ জনের নামোল্লেখসহ অজ্ঞাত ২০০ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করেন।
মো. সরোয়ার জাহান মাসুদ পরিবারের তিন ভাইয়ের মধ্যে বড়। তিনি ফেনী সরকারি কলেজের বিএসএস প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। দাগনভূঞার উত্তর জয়লস্কর মীর বাড়িতে ২০০৩ সালের ২৩ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করে সে। ২০২০ সালে সিলোনিয়া হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও পরে ২০২২ সালে দাগনভূঞা সরকারি ইকবাল মেমোরিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন মাসুদ। মাসুদের মেজ ভাই মাসুম আল সামির সরকারি ইকবাল মেমোরিয়াল কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ও ছোট ভাই সাইম সুলতান পড়ছে মাদ্রাসায়। বাবা শাহজাহান টিপু দুবাই প্রবাসী। মা বিবি কুলসুম একজন গৃহিণী।