বাজিকর
শৌ ভি ক বা গ চী

ভেজা গায়ে বসে থাকে মালতি।

লোকটার চোখে থাকে অপার স্নিগ্ধতা। তুলি দিয়ে কানভ্যাসে ফুটিয়ে তোলে অপাপবিদ্ধ অহল্যার এক নান্দনিক রূপ। এ কাজের বরাত টা পেয়েছে মালতি বেশিদিন নয়। প্রতিদিন রাতে নিরাভরণ হয়ে শুতেই হয় মালতিকে। নইলে পেট চলে না। ফুটন্ত গোলাপের পাপড়ি ছেঁড়া মাতালগুলোকে তার মত্ত হাতি বলে মনে হয়। এরা বাগান নষ্ট করে। আবার চারা গাছ পোঁতে মালতি নরম জমিনে। যদি ফুল হয়, যদি কেউ মুগ্ধ হয় -কিন্তু ফুল ঝরে যায় বিজ্ঞাপিত কন্ডোমের ব্যানারের আড়ালে।

কিন্তু এই লোকটা বিজ্ঞাপনের তোয়াক্কা করে না। সে শুধু তুলি বোলায়। ভেজা মালতির ভেজা স্তনে রত্নাকর ঝাঁপিয়ে পড়ে। লোকটা মুক্ত খুঁজে তুলিতে আনন্দের বাসর তৈরি করে। ভালো লাগে মালতির। দিন যায়। কানভ্যাস এ ফুটে উঠতে থাকে নীরব অহল্যা। অন্তর অবশ্য সরব হয়ে উঠতে চায়। কিন্তু কিছু বলে না মালতি।

লোকটা তুলি বোলায়। তাকিয়ে থাকে। তার আঙ্গুল নয়, তুলি ছুঁয়ে দেয় মালতিকে। কাজটা শেষ হয় একদিন। মালতি অবাক বিস্ময়ে দেখে ক্যানভাস। এই কি সে! রোজ রাতে শরীর বাজি রেখে যে মালতি নিয়ত হেরে গেছে এতকাল, মনে হয় আজ জিতে গেছে সে -অহল্যা হয়ে। অপাপবিদ্ধ অহল্যা ভুলিয়ে দেয় মালতিকে , সে কে । মালতি ভাবে সে মালতি নয়, সে মানুষী।

 

 

বিড়াল
মো হা ম্ম দ স ফি উ ল হ ক

কয়েকটি বিড়াল ছানা খেলছে। মনের সুখে খেলছে। দূর থেকে ওদের মা দেখছে। কি যে ভাল লাগছে বাচ্চাদের খেলা।

সুখ কি আর বেশী দীর্ঘ হয়? মা বিড়ালের ও সুখ বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। দু’টি নেড়ি কুকুর তেড়ে আসলো। ওমনি বিড়াল ছানাগুলো দিলো দৌড়। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পর একটি বিড়াল ছানা ঘুরে দাঁড়ালো। আমরা পালাবো? কেন? এই নেড়ি কুত্তার ভয়ে? আমরাতো বাঘের জাতি। কথাগুলো শুনে কুকুরগুলো থমকে গেলো।
বলে কি এই নাবালক! বাঘের জাতি! তোর মরার বেশ শখ হলো বুঝি? নেড়িদের দলনতা বললো।
আয় বাবা ফিরে আয়, সামনে দাঁড়াস না, মা বিড়ালের আহবানেও বিড়াল ছানাটি পিছু হটলো না। বাঘের মতো গরগর করে কাঁপতে লাগলো। নেড়িগুলো ভয় পেয়ে বুঝতে পারলো না! বাগে আনা যাবে না। তাই পিছু হটলো।

মা বিড়াল সন্তানের এমন আচরণে হতবাক ও ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে পড়লো। ভবিষ্যত বিপদের কথা ভেবে তার প্রাণ বুঝি যায় যায়। সে পথেই যাচ্ছিলেন এক বৃদ্ধ বিড়াল। সব শুনে বিড়াল ছানাকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলে উঠলেন- সাবাশ বেটা, সাবাশ! তোদের নিদারুণ এ অসময়ে বড্ড বেশি প্রয়োজন। তোকে দেখে দুর্বল দেহও ঝাঁকি দিয়ে নেড়ে ছেড়ে উঠলো। আসলে আমরা এক সময় বাঘ-ই ছিলাম, কিন্তু বিড়াল ভাবতে ভাবতে এখন বিড়াল হয়ে গেছি।

 

 

 

কারণবালা
অ ম ল কা ন্তি চ ন্দ

মনু মনপুই ধরে রোড বাইকটা ছুটছে। রাস্তার পাশ ঘেষে খানিক দূরেই জনজাতিদের পাড়া। টং ঘরগুলো লুঙ্গার পাশ থেকে রাস্তার দিকে উঁকি দিচ্ছে। একটা জায়গায় জটলা দেখে অভিনয় বাইক থামাল। কাছে গিয়ে ঘটনাটা বুঝার চেষ্টা করল।

-এই সরবে, তুই কিতারলাগি ইখান আইছস? জনজাতি মেয়েটি রীতিমত চোখ রাঙ্গিয়ে অভিনয়কে শাসাল।
অভিনয় বুঝতে পারল, তার এখানে যাওয়াটা ঠিক হয়নি। একটু আমতা আমতা করে বলল -তোমার নামটা কি জানতে পারি?
-নাম দিয়া কিতা করত বে? পাশে থাকা ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা হো হো করে হেসে উঠল।
-না, আ এমনিতে জানতে চাইলাম।
-জানবার লাগত না। আমরা ইখানে মোবালে সিনামা দেখছে। আর তুই আইয়া..

অভিনয় মনে মনে ভাবল এত সুন্দর মেয়েটা। ছেড়ে যেতে মোটেই ইচ্ছে করছে না তার। ওর পাশে গিয়ে বসতে চাইল। এবার মেয়েটি মুচকি হেসে বলল -সিনেমা দেখাইব নি বে? তর মোবাইলটা বড় আছে বে, দেখা না।
-তোমরা সবাই আস। অভিনয় ব্যাগ থেকে মোবাইলটা খুলতে খুলতে ইশারায় ডাকে।
-আইয়া, আ। মেয়েটি হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতেই অভিনয় তাড়াতাড়ি হাত টেনে তুলল। তার মুখের উপর গরম নিঃশ্বাস অনুভব করল মুহূর্তে। বাহানায় উঁচু বুক ছুঁইতে চাইল। মেয়েটিও আরো আপন হতে লাগল।
-ছাড়ব নি বে, হকলে দেখিলাইবতো। মেয়েটি সারা মুখ লাল হয়ে উঠে। এবার অভিনয় সরে দাঁড়ায়।

-তোমার নামটা বল না? অভিনয় আবারও বলল।

-কারণবালা। কেউরে কইছ না বে। আমার ডর হইছে বে। মেয়েটি কাঁপতে থাকে। অভিনয় পাহাড়ী রাস্তায় বারবার মোড় নেয়। যেতে যেতে কখন যেন ঘন জঙ্গলে হারিয়ে যায়।

 

 

 

 

খোলা চুলের সৌরভ
জা হা ঙ্গী র আ ল ম

প্রবল বাতাসে নৃত্য করছে তার খোলা চুল। মসৃণ চুলের ম্রিয়মাণ সৌরভ নিঃশ্বাসের সাথে মিশে গিয়ে অপূর্ব প্রশান্তির শীতল পরশে বিভোর করে তুলছে পাশে বসা নিলয়কে। ক্ষণেক্ষণে একগুচ্ছ চুল নাকের উপর এসে উড়ছে। মন্দ নয়, উড়তে থাকুক। চুলের পরশে যদি মন ভরে তাতে আপত্তি কেন? এখানে চুলের কি আর দোষ? দোষ যদি দিতে হয় তো বাতাসেরই দোষ। নিলয় কি বাতাসকে বলেছে, যে তার নাকের উপর ওর চুলগুলো এনে এনে ওড়াতে।
বাতাস তো আর নিলয়ের হুকুমে চলে না। খোলা জানালায় বাতাস হুহু করে ঢুকছে। কনকনে শীতের মাঝে জানালার একটি গ্লাস খোলা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে মেয়েটি। বাসটিও দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। দূরপাল্লার গাড়ি। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার। শীতের সময় অনেক পর্যটক এখানে আসে। গাড়িতে যাত্রী ভরপুর। ঠান্ডা বাতাস যাত্রীদের সহ্য হচ্ছিলো না। তাই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলো সবাই। যাত্রীর চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙলো মেয়েটির। তখনো তার চুলগুলো নিলয়ের মুখের উপর উড়ছে। মেয়েটি লজ্জা পেল। বিনয়াবনত হয়ে একবার স্যরি বলে নিজের চুলগুলো সরিয়ে নিল। তারপর জানালার গ্লাস টেনে দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লো মেয়েটি। নিলয় তার ঘুমন্ত মুখাবরণের দিকে চেয়ে চেয়ে নিজেকে হারাচ্ছে বারবার। তার প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন নিলয়ের কানে কানে এসে বলছে, ‘আই এম স্যরি।’ নিলয়ও অবচেতন মনে তাকে বলছে, ‘ইট’স ওকে। আমি কিছু মনে করি নি। বরং আমিতো তখন তোমার কোমল চুলের বাঁধনে জড়িয়ে নিজেকে হারিয়েছি তোমার সৌন্দর্যে।’ হঠাৎ গাড়ি থেমে গেল। হরিণচোখে চেয়ে মেয়েটি নেমে গেল লাভনি পয়েন্টে। নিলয় তখনো বসে বসে পাশে বসা মেয়েটির সৌরভী চুলের ঘ্রাণ নিচ্ছে। গাড়ির যাত্রীরা নেমে গেলে সুপারভাইজার এসে বলে, ‘স্যার, আমরা এখন লাভনি পয়েন্টে।’

 

 

 

 

রামঠাকুর আশ্রমে একদিন
আ ল ম গী র মা সু দ

প্রেমটা এক বা দুই বছরের বেশি কখনোই টিকে না আমার। বলা যায়, আমিই রাখি না। ১২ সালের শুরুর দিকে সায়েরা নামের ক্লাস টেনে পড়ুয়া এক মেয়ের সাথে আমার প্রেম হয়। আবেগী মেয়েটার সবকিছুই আমার ভালো লাগতো। শুধু ভালো লাগতো না, কথায় কথায় সেভ করার তাগিদটা।

সরকারি নামকরণ এক শহীদ সড়কের গোলচত্বরে আমাকে দাঁড় করিয়ে হাতে গুঁজে দেয়, পাঁচ শ টাকার একটি মুজিবমার্কা নোট। বললাম, ‘এটা কেনো?’
সায়েরা হুকুম দিয়েই জানান দিলো, ‘বিকালে দেখা করবা রামঠাকুর আশ্রমের ফুলবাগানটিতে।’ সাথে আরো বলে দিলো সে, ‘সেলুন থেকে মুখ পরিস্কার করে আসবা।’
মুজিবমার্কা নোটটি বারকয়েক তাকে সাধলেও নেয়নি! অগত্যা রিকশাওয়ালাকে বললাম, ‘মামা যা।’

একটা বিয়ার খেয়ে, শহরের অমরবাবুর দোকান থেকে বাকি টাকার চকলেট নিলাম প্রেমিকার সে টাকায়। ঠাকুরের কৃপায় রামঠাকুর আশ্রমটিতে পুজোর ফুল সবসময় দারুণ ফোটে। আজও বাগানে অনেক ফুলের দেখা। সেভহীন চেহারায় সায়েরার হাতে পেকেটটি দিয়ে বললাম, ‘ভালোবাসার মানুষকে গিফট করলে সবার আগে ঠাকুরজি খুশি হয়। তাই এই চকলেটগুলো তোমার জন্য নিয়ে আসলাম।’
চকলেটসহ পেকেটটি মাটিতে ফেলে সায়েরা দ্রুত পায়ে চলে যাওয়ার সময় উচ্চস্বরে বলেই দিলো, ‘তুমি আর আমার সাথে কখনোই যোগাযোগ করবা না।’

‘হাহাহা...’
মুহূর্তে রামঠাকুর আশ্রমের মূর্তিটাকে অসহায় শিশুর মতোই মনে হলো আমার। কারণ দেশের বহু মন্দিরে আমার প্রেম খাঁটি হলেও, সেবার-ই প্রথম সায়েরা চলে গেলো কোনো এক পবিত্র স্থান থেকে। আর রামঠাকুর আশ্রমের মূর্তিটা তখনও তাকিয়ে ছিলো-আমার হাসিমাখা মুখের দিকে।